রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে বলে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে মন্তব্য করেছেন। বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা ও নানামুখী তৎপরতার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নিস্ত্রিয়তা ও নির্লিপ্ততার কারণে এমন আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু রাজনীতি ও ভূরাজনৈতিক সম্পর্কের প্রশ্নে শেষ কথা বলে কিছু নেই। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মালয়েশিয়া সফরের সময় মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বরফ গলাতে সেখানে শান্তি মিশন পাঠানোর উদ্যোগের কথা বলেছেন। মালয়েশিয়ার রাজধানী পুত্রাজায়ায় ইউনূস-ইব্রাহিম দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর যৌথ সংবাদসম্মেলনের বিবৃতিতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নিপীড়ন রোধ এবং বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের পুর্নবাসন প্রশ্নে একটি বহুজাতিক শান্তিমিশন নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহামাদ হাসানকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইন থেকে সদস্য নিয়ে গঠিত সম্ভাব্য শান্তি মিশন আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমার সফরে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে প্রথমেই মিয়ানমারে বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা, গৃহযুদ্ধে বাস্তুচ্যুত ও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের পুর্নবাসনের দিকে বিশেষ নজর দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আসিয়ানের নেতৃত্বে থাকা মালয়েশিয়ার তরফে এমন উদ্যোগ সংকট নিরসনে নতুন প্রত্যাশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে। ড. ইউনূসের সাথে আনোয়ার ইবরাহিমের বন্ধুত্ব দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্কন্নোয়ন ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তার প্রশ্নে এক যুগান্তকারি অবস্থানে উন্নীত হতে চলেছে ।

দীর্ঘদিন ধরেই মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। মধ্যপ্রাচ্যের পর মালয়েশিয়া হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার তথা কর্মসংস্থানের অন্যতম স্থান। বিগত সরকারের আমলে এ ক্ষেত্রে কিছু অহেতুক জটিলতা ও টানাপোড়েন সৃষ্টি হলেও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে চেষ্টা-তদ্বির করেও কোনো সুরাহা করতে পারেনি। ড.ইউনূসের নেতৃত্বে অর্ন্তবর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই মালয়েশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বহুমাত্রিক অগ্রযাত্রার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ড. ইউনূসের আমন্ত্রণে আনোয়ার ইবরাহিমই হচ্ছেন বাংলাদেশ সফরকারি প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী। গত বছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে তিনি একদিনের সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকা এসেছিলেন। তারই পাল্টা সফরে ড. ইউনূস তিনদিনের সফরে মালয়েশিয়া গেছেন। এই সফরে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার মালয়েশিয়ার সাথে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা চুক্তি(এমওইউ) এবং ৩টি নোট স্বাক্ষরিত হয়েছে। মালয়েশিয়ার সাথে বাণিজ্যবৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ থেকে আরো বিপুল সংখ্যক জনবল নিয়োগের সম্ভাবনা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রস্তাবিত শান্তি মিশনের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন ও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের নতুন সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে। কোনো আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক পরাশক্তির স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রভাবের বাইরে সরাসরি মিয়ানমার সরকারের সাথে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিদের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ খুবই ইতিবাচক ও কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ বাংলাদেশসহ পুরো অঞ্চলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধ মিয়ানমারের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে যেমন পিছিয়ে দিচ্ছে, তেমনিভাবে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থির চাপ বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

দীর্ঘদিন পর রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের প্রশ্নে একটি ইতিবাচক ধারার সূচনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমাদের মদতে ইতিপূর্বে যে সব পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছিল, সে সবের ভিত্তি যে খুব দুর্বল তা সহজেই অনুমেয়। আরাকান আর্মির সাথে বোঝাপড়ার ফাঁদে ফেলে পুরো বিষয়টিকে আরো জটিল করে তোলার হীনচেষ্টাও লক্ষ্য করা গেছে। ইতিমধ্যে আরাকান আর্মিতে বড় ধরণের দুর্বলতা ও ভাঙ্গনের আভাস পাওয়া গেছে। জান্তা বাহিনীর পাল্টা হামলায় টিকতে না পেরে আরাকান আর্মির অনেক সদস্য আত্মসমপর্ণ করে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয়ের অপেক্ষা করছে বলে গতকাল প্রকাশিত খবরে জানা যায়। এই আরাকান আর্মি মূলত বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসিদের দ্বারা গঠিত সশস্ত্র গ্রুপ। জান্তা বাহিনী ও এদের গণহত্যা ও নিপীড়নের শিকার হয়েই ২০১৭ সালে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। সে সময় পশ্চিমা বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেয়ার আহ্বান জানালেও গত ৮ বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা অভিবাসিদের জন্য জাতিসংঘের সহায়তা তহবিল অর্ধেকে কমিয়ে দেয়ার মাধ্যমে একটি মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টির আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ানমার নীতিতে পরিবর্তনের সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্তত ৫ ব্যক্তির উপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। মিয়ানমারে চীন, জাপান, ভারত, রাশিয়াসহ আঞ্চলিক পরাশক্তির বিপুল বিনিয়োগ ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। এখন সম্পর্ক উন্নয়ন ও সমঝোতার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলের রেয়ার আর্থ মিনারেল ও খনিজসম্পদের উপর বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে চাইছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। রাখাইন সীমান্তে আরাকান আর্মির সন্ত্রাসি কর্মকান্ডে মার্কিন সমর্থন আছে বলে মনে করা হয়। এদের প্রতি নমনীয়তা নয়, কঠোরভাবে প্রতিহত করার নীতি গ্রহণ করতে হবে। মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখার মাধ্যমে যদি রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হয়, সেদিকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বঙ্গোপসাগরে অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার সাথে সাথে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে চীন, মিয়ানমার, মালয়েশিয়াসহ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সমন্বিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সাথে জি টু জি আলোচনা ও সামগ্রিক কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে।

সূত্র, ইনকিলাব