বিশ্বে তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ। কিন্তু তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে এরই মধ্যে ভিয়েতনাম বাংলাদেশের এক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

আগামী ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ থেকে আমদানীকৃত পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যখন শুল্ক বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, তার মাঝেই দুদিন আগে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা এক পত্রে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্প তার এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। সেই পত্রে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশ যদি তার বাণিজ্য বাজার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় এবং সেই সঙ্গে তার শুল্ক ও অশুল্ক নীতি এবং বাণিজ্য বাধা দূর করে দেয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান তার পত্রের কোনো কোনো অংশ পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারেন।

পুরো প্রক্রিয়াটির একটি ক্রমানুক্রনিক প্রেক্ষিত আছে। এ বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করার দুই মাসের মাথায় এপ্রিলের শুরুতেই ডোনান্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে, সেসব দেশের ক্ষেত্রে পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হবে। যুক্তি দেখানো হয় যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এতদিন নানান দেশ বিভিন্ন রকমের অন্যায্য বাণিজ্য সুবিধা নিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল ঘাটতিকে আরো বিস্তৃত করে দিয়েছে। দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট হারের শুল্ক ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিশ্বব্যাপী। অন্যান্য দেশও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত শুল্ক বসানোর হুমকি দিল এবং শুরু হয়ে গেল এক অকথিত ‘শুল্কযুদ্ধ’। বিশ্বের চাপের মুখে যুক্তরাষ্ট্র তার অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ কার্যক্রম তিন মাসের জন্য স্থগিত করে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয়ভাবে বাণিজ্য আলোচনা শুরু করে দেয় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এবং বলা হয় যে তিন মাস সময়সীমার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের জন্য শুল্কহার ধার্য করবে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।

এ চালচিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচটি বিষয় এখানে উল্লেখিত হওয়া প্রয়োজন। এক. শুল্কের পুরো ব্যাপারটি যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয়ভাবে মেটাতে চেয়েছে, সেখানে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার প্রতি দেশটি ভ্রুক্ষেপই করেনি। তাই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং তার নিয়মকানুনকে যুক্তরাষ্ট্র আমলের মধ্যেই আনেনি। দুই. যুক্তরাষ্ট্র শুল্কযুদ্ধ শুরু করেছে শুল্কের জন্য নয়, বাণিজ্যের জন্যও নয়, এটার পেছনে মূলত রয়েছে নানান রাজনৈতিক বিবেচনা। তিন. তিন মাস সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই ১৪টি দেশের ওপর নানা হারে শুল্কহারের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুল্কহার ব্যাপকভাবে কমানো হয়েছে, যেমন কম্বোডিয়া (৪৯ থেকে ৩৬ শতাংশ); কোথাও কোথাও তা সামান্য হারে কমানো হয়েছে, যেমন তিউনিসিয়া (২৮ থেকে ২৫ শতাংশ); কোনো কোনো দেশের ক্ষেত্রে শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, যেমন থাইল্যান্ড এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বাড়ানোও হয়েছে, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া (২৪-২৫ শতাংশ)। চার. যুক্তরাজ্য ও ভিয়েতনামের সঙ্গে এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে ভিয়েতনামের শুল্কহার ধার্য করা হয়েছে ২০ শতাংশ। ভারতের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। পাঁচ. বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বর্তমান ঘোষিত অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আগের ৩৮ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণার চেয়ে ৩ শতাংশ কম। তবে যেহেতু বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি শুল্কের গড় হার ১৫ শতাংশ, তাই এ অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হলে বাংলাদেশের জন্য প্রকৃত শুল্কহার হবে ৫০ শতাংশ।

এ শুল্কহার বৃদ্ধি আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশের পণ্য রফতানির একক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ ৮৭০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে, যা দেশের রফতানি আয়ের ১৮ শতাংশ। বাংলাদেশের ২ হাজার ৩৩৭ প্রতিষ্ঠান রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ঘোষণায় দেশের আট শতাধিক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শুল্ক বৃদ্ধিতে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিশাল বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে রফতানীকৃত বাংলাদেশী পণ্যের ৮৭ শতাংশেরও বেশি তৈরি পোশাক। এ দেশের ১ হাজার ৮২১ পোশাক তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান বিদেশে পোশাক রফতানি করে। পোশাক রফতানি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস—প্রতি বছর বাংলাদেশ তৈরি পোশাক থেকে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি আয় করে। এ খাতে ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন, যাদের ৮০ শতাংশেরও বেশি নারী। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত শুল্ক বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে কর্মনিয়োজন কমে যেতে পারে, কারণ পোশাক শিল্পের বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছোট ছোট শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যাপক বেকারত্বের শিকার হতে পারেন নারী শ্রমিকরা। শেষোক্ত প্রভাবের বিস্তৃত আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক মাত্রিকতা আছে।

বিশ্বে তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে চীনের পরেই দ্বিতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ। কিন্তু তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে এরই মধ্যে ভিয়েতনাম বাংলাদেশের এক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের রফতানির ওপর মাত্র ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, তাই খুব স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ ভিয়েতনামের কাছে তার যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট বাজার হারাতে পারে।

বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিকতম ঘোষিত ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্কের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে যে অতিরিক্ত শুল্কের কথা বলা হয়েছে সেই এপ্রিলে। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ কী কী করতে পারেনি, যাতে শুল্কহার ভিয়েতনামের পর্যায়ে কমিয়ে আনা যায়নি? বাংলাদেশ কি বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারেনি, আমাদের কি তেমন কোনো প্রস্তুতি ছিল না, নাকি এমনটা যে হতে পারে তা আমাদের চিন্তাতেই আসেনি?

এসব ব্যাপারে নানান জনের নানান রকম মত। সেসব মতামত বিন্যস্ত করলে পাঁচটি ধারণা বেরিয়ে আসে। এক. যতখানি গুরুত্বের সঙ্গে এবং নানা মাত্রিকতার গভীরতর বিবেচনার সঙ্গে বিষয়টির ব্যাপারে এগোনো দরকার ছিল তা করা হয়নি। কৌশলী হওয়ার অভাবও চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে পুরো প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের নানাজন বিচ্ছিন্নভাবে খণ্ডিত প্রয়াসে অংশগ্রহণ করেছেন। সেখানে সমন্বিত একটি প্রচেষ্টার অনুপস্থিতি অনেকে লক্ষ করেছেন। দুই. অভিযোগ করা হয়েছে যে দরকষাকষির প্রক্রিয়ায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যুক্ত করা হয়নি। নিয়োগ করা হয়নি তদবিরি সংস্থাদের, যা এমন সব প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত জরুরি। তিন. যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধের রাজনৈতিক মাত্রিকতা ও গুরুত্ব বাংলাদেশ পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পেরেছে কিনা, সে ব্যাপারেও অনেক বিশেষজ্ঞ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেমন যেসব দেশে চীনের বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক প্রভাব বেশি, সেসব দেশের ওপর রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র বেশি চাপ প্রয়োগ করেছে। হয়তো সে কারণে বাংলাদেশও বাড়তি সুবিধে আদায় করতে পারেনি।

পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে আলাপ-আলোচনার জন্য এখনো কিছুটা সময় আছে এবং সে সময়টাকে অত্যন্ত দক্ষ ও কার্যকরভাবে কাজে লাগাাতে পারলে আরো কিছু শুল্ক সুবিধা আদায় করা যেতে পারে। তার জন্য কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বুঝতে হবে। যেমন আমাদের বুঝতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাঠামো মানবে না, মানবে না আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় সেসব কথা বলা বৃথা। বাংলাদেশকে বুঝতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের আসল দৃষ্টিভঙ্গি কী এবং সেভাবেই আমাদের কৌশল সাজাতে হবে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র তার বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর কথা বলছে, সুতরাং কোন কোন ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো যায়, তা ভেবে দেখা যেতে পারে। এ ব্যাপারে এর মধ্যেই বাংলাদেশ কিছু কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। সেগুলো পুনর্মূল্যায়িত হওয়া প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রকে কী কী বাণিজ্য সুবিধা দিলে কী কী শুল্ক সুবিধা বাংলাদেশ পেতে পারে, পারস্পরিক আলোচনাটির সেখানে মনোনিবেশ করা দরকার। এ ব্যাপারে তদবিরি সংস্থাদের নিয়োগ করা যেতে পারে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক বিবেচনা এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই শুল্কযুদ্ধটি শুরু করেছে। বাংলাদেশের জানা দরকার যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সে বিবেচনা এবং দৃষ্টিভঙ্গিটি কী? পারস্পরিক আলোচনায় সে বিষয়গুলো নিয়ে আসা দরকার। কারণ বাণিজ্যিক সুবিধার পাশাপাশি রাজনীতিও কাজ করে। সেটাকে ব্যবহার করেই ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়া শুল্কছাড় পেয়েছে। চতুর্থত, শুল্ক আলোচনায় মোর্চা গঠনের বিষয়টিও মনে রাখা দরকার। আলোচনা দ্বিপক্ষীয় হোক ক্ষতি নেই, কিন্তু অবস্থানটি যেন যূথবদ্ধ হয়।

শেষ যে কথাটি মনে রাখা দরকার, সেটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষিতে যাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আছে, তেমন বাংলাদেশীদের বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা দরকার। এ জাতীয় আলাপ-আলোচনার একটা ভাষা আছে, যা বাক্-ভাষা এবং দেহভঙ্গি ভাষাও বটে। সেগুলোর সঙ্গে পরিচিতি এবং তার প্রয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষির জন্য অপরিহার্য।

সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

সূত্র, বণিক বার্তা