বিমান বাহিনীর বিমান দুর্ঘটনায় উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে তিরিশের অধিক শিক্ষার্থীর মৃত্যু এবং শতাধিক আহত-অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনায় পুরো জাতি যখন শোকে মুহ্যমান, তখন সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠেছে। গত মঙ্গলবার মাইলস্টোন কলেজের দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে শিক্ষা সচিব সিআর আবরার, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে দিনভর অবরুদ্ধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা। বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের তথ্য গোপনের অভিযোগ, প্রকৃত সংখ্যা তুলে ধরার দাবি, শিক্ষা সচিব ও শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ, সকলের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণসহ ৬ দফা দাবিতে মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে ৬ দফা দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়নের আশ্বাস এবং দিয়াবাড়ি সেনাক্যাম্পের পক্ষ থেকে যে কোনো সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরও শিক্ষার্থীরা কোনো কিছুতেই কর্ণপাত না করে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, সাধারণ শিক্ষার্থী ছাড়াও বহিরাগত বিশেষ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভে যোগ দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে বলে জানা যায়। মাইলস্টোন দুর্ঘটনাকে পুঁজি করে তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে অবরোধসহ ধ্বংসাত্মক তান্ডবে মেতে ওঠে। দাবিসমুহ মেনে নিয়ে সকালেই শিক্ষাসচিবকে প্রত্যাহার করার পরও নামধারি শিক্ষার্থীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং নিরাপত্তা বেষ্টনি ও সচিবালয়ের গেট ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে গাড়ি ভাঙচুর শুরু করলে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড চার্জ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ ও যৌথ বাহিনী।
বিমান দুর্ঘটনায় মাইলস্টোন স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীদের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুতে পুরো জাতি যখন শোকসন্তপ্ত, মঙ্গলবার সরকার ঘোষিত জাতীয় শোক দিবস পালিত হচ্ছিল, এরই মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও দাবি-দাওয়ার আড়ালে পতিত স্বৈরাচারের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী বাহিনী ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে মিশে সচিবালয়ে ভয়ঙ্কর তান্ডবে মেতে ওঠে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজে ছাত্রদের মধ্যে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ছবি ধরা পড়ে। মাইলস্টোন কলেজে নিহতদের লাশ গুম করার গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সংক্ষুব্ধ করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা নেপথ্যে নেতৃত্ব দিয়ে সচিবালয়, মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন স্থানে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ গড়ে তোলে। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী অস্থিতিশীল সময়ে ছাত্রলীগসহ পতিত সরকারের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করে ফায়দা লোটার নানাবিধ অপচেষ্টা চালিয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে আনসারদের সংগঠিত করে সচিবালয় দখলেরও চেষ্টা করেছে। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে অচলাবস্থা থাকলেও ছাত্র-জনতার ঐকবদ্ধ প্রতিরোধে তাদের প্রতিটি অপতৎপরতা ব্যর্থ হয়েছে। বিমান দুর্ঘটনায় হতাহত শিশুকিশোর ও শিক্ষকদের বিয়োগান্তক ঘটনার সময় যখন সকলকে ঐকবদ্ধভাবে দুযোর্গ মোকাবেলায় উদ্ধার অভিযান চলছিল, নিহতদের দাফন, বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টরা হিমসিম খাচ্ছে, শত শত মানুষ হাসপাতালে রক্ত দান করতে ভীড় করছে, তখন পতিত স্বৈরাচারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ছাত্রলীগের পান্ডারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে মিশে ন্যক্কারজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছে। তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের হত্যাচেষ্টা ও তান্ডবের পর পলাতক ছাত্রলীগ এখন ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গুপ্তঘাতকের ভূমিকায় অবর্তীণ হতে শুরু করেছে। বিমান দুর্ঘটনায় বিয়োগান্তক ঘটনাকে পুঁজি করে গুজব ছড়িয়ে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে তারা সচিবালয়ের নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে তান্ডব চালিয়েছে। সোমবার দুপুর একটায় বিমান দুর্ঘটনায় মাইলস্টোন স্কুলে শিক্ষার্থীদের প্রাণহানির ঘটনার পর মধ্যরাত পর্যন্ত পরবর্তী দিনের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের নোটিশ দিতে শিক্ষা মন্ত্রণলয়ের ব্যর্থতা অস্বীকার করা যায় না। এ ঘটনা শিক্ষা উপদেষ্টা ও সচিবের অযোগ্যতা ও অমনোযোগিতা হিসেবে গণ্য হওয়া স্বাভাবিক। রাত আড়াইটায় পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হলেও অনেক শিক্ষার্থী সকালে পরীক্ষা কেন্দ্রে গিয়ে তা জানতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায়ে শিক্ষা সচিবকে প্রত্যাহার করাসহ শিক্ষার্থীদের প্রায় সব দাবি মেনে নেয়ার পরও সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর আক্রমণ, ফটক ভেঙে ভেতর প্রবেশ করে গাড়িভাঙ্গচুরের ঘটনা থেকে বোঝা যায়, পুরো বিষয়টি ছিল যথেষ্ট পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ-সমন্বিত তৎপরতার ফল। এ ধরণের তৎপরতা জুলাই অভ্যুত্থানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জনগণ ও অংশীজনদের ভাবিয়ে তুলেছে। পরিস্থিতি মূল্যায়নে মঙ্গলবার রাতে দেশের প্রধান চারটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে জরুরি বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড.ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা পতিত ফ্যাসিস্টের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় রাজনৈতিক পক্ষগুলোর ঐকবদ্ধ ভূমিকার উপর গুরুত্বারোপ করেন বলে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন। বৈঠকে অংশগ্রহণকারি রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেছেন, নির্বাচনসহ রাজনৈতিক প্রশ্নে কিছু মতভিন্নতা থাকলেও ফ্যাসিবাদ মোকাবেলার প্রশ্নে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ বা মতভেদ নেই। এ বিষয়টি সকলেই বুঝতে পারছেন এবং স্বীকার করছেন যে, পরাজিত শক্তি যে কোনো পরিস্থিতির সুযোগ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাদেরকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করেই দেশকে নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে নিতে হবে। গোপালগঞ্জ, সচিবালয় এবং মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে তান্ডবের সাথে জড়িতরা যেন কোনো অজুহাতেই রেহাই না পায়। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে হবে। নির্বাচন কেন্দ্রিক ভেদাভেদ ভুলে নতুন ও পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোকে পতিত স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্য অটুট রাখতে হবে।