বৈশ্বিক ভূরাজনীতি ও আঞ্চলিক বাস্তবতায় সামরিক ও প্রযুক্তিগতভাবে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে বৃহৎ সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তির একচ্ছত্র আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের তিনটি আঞ্চলিক যুদ্ধ বিশ্বকে এক নতুন বাস্তবতার সম্মুখীন করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধে প্রমাণ হয়েছে, নিজের সামর্থ্যরে বাইরে পরাশক্তির বিরোধকে কাজে লাগিয়ে কোনো যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া বোকামি। স্থানীয় ও আঞ্চলিক বাস্তবতা উপেক্ষা করে ইউরোপ-আমেরিকার ফাঁদে পা’ভলোদিমির জেলেনস্কি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হওয়া এবং রাশিয়াকে বেকায়দায় ফেলতে ন্যাটোতে যোগ দেয়ার মধ্য একটি নতুন ঠান্ডা লড়াইয়ের সুত্রপাত করার পাঁয়তারা থেকেই ২০২২ সালে ইউক্রেন রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার হয়। স্থানীয় জনগনের প্রত্যাশা ও ভাবাবেগের বাইরে গিয়ে পশ্চিমাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার টোপ গিলে ২০১৪ সালে রাশিয়ার কাছে ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ ও দখল হারিয়ে ইউক্রেন তার রাষ্ট্রীয় অখ-তা হারিয়েছিল। ক্রিমিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের চিন্তা করে নতুন যুদ্ধের ছক সাজিয়ে এখন পুরো ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতে চলে যেতে বসেছে। সম্প্রতি রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন পুরো ইউক্রেন দখলে তার অভিপ্রায়ের কথা বললেও পশ্চিমাদের তরফ থেকে তেমন কোনো শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। গত সপ্তাহে নেদারল্যান্ডের হেগে অনুষ্ঠিত ন্যাটো জোটের বিশেষ সামিটে জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা ও সামরিক বাজেট কমপক্ষে জিডিপি’র ৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়। যেখানে বিশ্বে ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে, দারিদ্র্যের কারণে এশিয়া-আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে কোটি কোটি শিশু চরম খাদ্যাভাব, অপুষ্টিতে ভুগছে, শতকোটি মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে, সেখানে পশ্চিমা দেশগুলো বিশ্বকে নতুন সামরিক হুমকি ও অস্ত্র প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিতে চাইছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে তাদের উৎপাদনশীলতা ও ম্যানুফেকচারিং খাত যখন উঠতি অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলোর কাছে মার খেতে চলেছে, তখন তারা ইভিল ক্যাপিটালিজম বাঁচিয়ে রাখতে যুদ্ধ অর্থনীতির উপর নির্ভর করতে চাইছে। পশ্চিমারা তাদের সাবেক উপনিবেশগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে চায় না। শত বছর আগের আঞ্চলিক বোঝাপড়া ও চুক্তি, দেশগুলোকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে বিভক্ত সীমারেখায় প্যাঁচ লাগিয়ে আঞ্চলিক বিরোধ জিইয়ে রাখার মধ্য দিয়ে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসির কার্যকারিতা তারা এখনো ধরে রেখেছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার মত একসময়ের একই অখ- রাষ্ট্রের সীমারেখায় পাঞ্জাব, কাশ্মির ও বাংলার চাতুর্যপূর্ণ বিভক্তি যুগে যুগে যুদ্ধের আশঙ্কা ও ভয়াবহতা উস্কে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে পশ্চিমা হিসেব-নিকেষ আমূল পাল্টে দিয়েছে। অনেক বাগাড়ম্বরের অখ- ভারতের প্রবক্তারা পাকিস্তানের দুর্বল অর্থনীতির দিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের আঙুল উঁচিয়ে, ইসলামোফোবিক এজেন্ডায় সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বয়ান হাজির করে পাকিস্তানের উপর সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে বড় ধরণের অভাবনীয় পাল্টা আঘাতের সম্মুখীন হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধরে যুদ্ধ বিরতী করতে বাধ্য হয়েছে। কূটনৈতিক আলোচনা ও বোঝাপড়ার সুযোগ কাজে না লাগিয়ে নিজেরা সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর কাছে ভারতীয় বাহিনী চরম মার খেয়ে দুইদিনের মধ্যেই যুদ্ধ বিরতী করে বিশ্বের কাছে ভারতের হামবড়া মুখে কালিমা লেপন করেছে নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী সরকার। গত অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে ইরান-ইসরাইল-আমেরিকার ১২ দিনের যুদ্ধ সম্ভবত সবচেয়ে চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। কিছুটা ভিন্নমতের ভান করলেও মধ্যরাতে অতর্কিতে ইরানে ইসরাইলের সামরিক হামলা এবং সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিদের টার্গেটেড কিলিংয়ের পরিকল্পনার সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পেন্টাগন প্রশাসনের সমর্থন ও বোঝাপড়া ছিল। তারা আশা করেছিল, ইসরাইলকে দিয়ে ইরানের পারমানবিক সক্ষমতা ধ্বংস করে দিতে পারবে। তা হয়নি, ইরানের পাল্টা ক্ষেপনাস্ত্র হামলায় ১০ দিনেই ইসরাইল কাবু হয়ে পড়া ইসরাইলের লক্ষ্য পুরণে ট্রাম্প নিজেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে ৪০ ঘন্টা বি-২ স্পিরিট বোম্বার উড়িয়ে শতাধিক যুদ্ধ বিমানের বহর নিয়ে ইরানের তিনটি পারমানবিক কেন্দ্র ও সামরিক ঘাঁটিগুলোর উপর শত কোটি ডলারের বোমা ফেলেও ইরানের প্রতিরোধ শক্তি কমাতে পারেনি। পাল্টা হামলায় একদিনেই মধ্যপ্রাচ্যের ৫টি মার্কিন সামরিক ঘাটিতে ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়ে, ইসরাইলের তেলআবিব, হাইফা, বিরশেবা, আশদদে ধ্বংসের তা-ব চালিয়ে ট্রাম্পকে যুদ্ধ বিরতিতে বাধ্য করার এক বিস্ময় জাগানিয়া ইতিহাস সৃর্ষ্টি করেছে ইরান।

পারস্য বা ইরানের সাড়ে ৩ হাজার বছরের ধারাবাহিক সমৃদ্ধ ও অপরাজেয় ইতিহাস রয়েছে। রাসুল (স.) ওফাতের কয়েক বছর আগে পারস্যের সাসানীয় স¤্রাট দ্বিতীয় খসরুর কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র পাঠিয়েছিলেন। সমরাট তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। রাসূলের ওফাতের ২ বছর পরে খোলাফায়ে রাশেদিন বাহিনীর কাছে পারস্য আত্মসমর্পণ করে নতুন এক বিজয়ের ধারায় অবগাহন করেছিল। এরপর দেড় হাজার বছরেও পারস্য কোনো পরাশক্তির কাছে পরাভব মানেনি এবং কোনো দেশে সামরিক আগ্রাসন চালায়নি। গত শতকে ১৯৭৯ সালে ইসলামিক রেভ্যুলেশনের আগের ২৫ বছর এবং পরের ৪৫ বছর ইরানের জাতীয় ইতিহাসের সবেচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়। ¯œায়ুযুদ্ধোত্তর সাড়ে তিন দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের ভূরাজনীতি মূলত ইরানের কথিত পরমাণু কর্মসূচির জুজু দেখিয়ে ইরানের অগ্রযাত্রা ঠেকানোর নীলনকশাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২ দশক ধরে শত শত বিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট ব্যয় করে দেশগুলোকে কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত করার মধ্য দিয়ে ইরানকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। ইসরাইল মূলত মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষায় পেন্টাগনের একটি পাপেট রেজিম হিসেবে কাজ করছে। একেকটা প্রোপাগান্ডা ও ইসলামোফোবিক বয়ান হাজির করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পারস্পরিক আস্থাহীনতা ও বিভেদ সৃষ্টি করা এবং সামরিক আধিপত্য ব্যবহার করে দেশগুলোর সামরিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নস্যাৎ করে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল করে রাখাই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের মূল এজেন্ডা। এর বিপরীতে ইরান এবং আফগানিস্তান আধিপত্যবাদী পশ্চিমা বিশ্বের জন্য ভিন্ন বার্তা ও দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে। মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী ২০ বছর ধরে শত শত কোটি ডলারের সর্বাধুনিক ও শক্তিশালী সমরাস্ত্র ব্যবহার করেও আফগান তালেবানদের নেটওয়ার্ক ও মনোবল ভেঙ্গে দিতে পারেনি। অবশেষে তাদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে রাতের আঁধারে সেনাঘাঁটিগুলো থেকে পশ্চিমা বাহিনীা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। বিশ বছরেও তালেবানের রিজিম চেঞ্জ এজেন্ডা বাস্তবায়নে সফল হতে পারেনি। পশ্চিমা সহায়তা ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই তালেবানরা সার্বভৌম শক্তি হিসেবে আফগানিস্তানে এক বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সম্ভাবনার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে তেলসম্পদে সমৃদ্ধ পশ্চিমা বশংবদ শাসকরা নিজেদের জন্য শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন ও ভোগের সামগ্রির নিশ্চয়তা ছাড়া আর কিছুই অর্জন করতে পারেনি। পক্ষান্তরে, সব ধরনের অর্থনৈতিক, বানিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত নিষেধাজ্ঞা দিয়েও ইরানের সামরিক, প্রযুক্তিগত, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও অগ্রযাত্রা রুখতে পারেনি। পশ্চিমাদের অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা এবং বৈরীতার মুখে যেসব দেশ মাথা নত না করে নিজেদের জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছে, তারাই এখন পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীর শক্তির চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে। উত্তর কোরিয়া, আফগানিস্তান, ইরান এবং পাকিস্তান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাতে ভারতীয় বিমান বাহিনী বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ফরাসি রাফায়েল যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেও পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত সস্তার চিনা ফাইটার জেটের কাছে নাস্তানাবুদ ও পরাস্ত হয়েছে। দুই দিনের যুদ্ধে অন্তত তিনটি রাফায়েল যুদ্ধবিমান পাকিস্তানী বৈমানিকদের হাতে ভূপাতিত হলেও পাকিস্তানের একটি বিমানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, শুধু অত্যাধুনিক লজিস্টিক ও প্রযুক্তি থাকলেই হয়না, তা সঠিকভাবে পরিচালনার কৌশল জানতে হয়। বিগত সাত দশকে অন্তত তিনটি আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ক্ষুদ্র ইসরাইলের কাছে মধ্যপ্রাচ্যের কোটি কোটি মানুষের সম্মিলিত আরব বাহিনী পরাজিত হয়েছে। এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, প্রতিটা যুদ্ধেই্ ইঙ্গ-মার্কিন সামরাজ্যবাদী শক্তি নিজেদের সামরিক শক্তির পাশাপাশি কূটনৈতিক উদ্যোগ ও কলাকৌশল ব্যবহার করে বিশেষ মুহুর্তে ইসরাইলকে জিতিয়ে দেয়ার কারসাজি করেছে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইরানের হাতে পাল্টা মার খেয়ে ইসরাইলের আগ্রাসন, প্রতিরোধ সক্ষমতা এবং দীর্ঘদিনে গড়ে তোলা জৌলুসপূর্ণ নগরীগুলো একে একে ধুলোয় মিশে যাওয়ার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজে যুদ্ধে জড়িয়েও রক্ষা করতে না পেরে বড় যুদ্ধের হুমকি ও লোভনীয় অর্থনৈতিক প্রলোভনের টোপ দিয়ে যুদ্ধ বিরতী নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। মার্কিন ছত্রছায়া না থাকলে বহু আগেই ইসরাইল আরবদের সাথে সমঝোতা করে টু-স্ট্যাট সলিউশানের আওতায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধ্য হতো। ইরানের জাতীয় ঐতিহ্য ও দেশের জন্য, ধর্মের জন্য ইরানিদের আত্মত্যাগ, ধৈর্য ও যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিজেদের প্রস্তুত করার মানসিকতাই পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিরোধ সক্ষমতাকে এ পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এ শক্তি শুধু প্রযুক্তির সক্ষমতা নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে ইস্পাতকঠিন জাতীয় ঐক্য এবং ইসলামি আদর্শ, জীবনবোধ ও আধ্যাত্মিক চেতনার শক্তি। আগ্রাসনের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ সক্ষমতা অনেক বেশি কার্যকর হয়ে থাকে। পশ্চিমা জোটের বিরুদ্ধে আফগানিস্তান, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান এবং ইসরাইল-আমেরিকার বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিরোধ সক্ষমতা বিশ্বের সামনে এক নতুন বিশ্ববাস্তবতা সৃষ্টি করেছে। ইরান, ইসরাইল, ইউক্রেন পাকিস্তানের চলমান বাস্তবতা বাংলাদেশের জন্য এক চরম বার্তা প্রদর্শন করছে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারত যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার আসনে বসাতে সব সময়ই কুণ্ঠিত ও অপ্রস্তুত। বাংলাদেশের সাথে ভারতের এমন আচরণ একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে তাদের সমর্থন ও সহায়তার নেপথ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে এ দেশের মানুষকে সন্দিহান করে তুলেছে। এক শ্রেণীর মানুষ ও কয়েকটি রাজনৈতিক দল একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। তারা যুক্তি দেখিয়েছিল, ভারত মূলত পাকিস্তানকে বিভক্ত করে বাংলাদেশকে তার পদানত করতে চায়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের উপর ভারতের বহুমাত্রিক আগ্রাসনে গত ৫৪ বছরে সেসব স্বাধীনতা বিরোধিদের বক্তব্যই যেন প্রতিফলিত হয়েছে। বহু আগে মাওলানা ভাসানী নাকি বলেছিলেন, ভারত আমাদের শত্রু, এ বিষয়টি যে প্রজন্ম বুঝতে পারবে, তারাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমাদের জেন-জি প্রজন্ম পাকিস্তান আমল দেখেনি, একাত্তুর দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী আমলে শেখ মুজিবের বাকশালি শাসন দেখেনি। তারা জন্মের পর থেকে শেখ মুজিবের বন্দনা শুনেছে। বইপুস্তকে, টিভিতে-সিনোমায়, গণমাধ্যমে শেখ পরিবারের জয়জয়কার শুনেছে। প্রতিটি দেয়ালে সারাদেশে মূর‌্যালে, প্রতিকৃতিতে, কর্ণারে কর্ণারে এক ব্যক্তিকে মহামানবে পরিণত করার দুর্বিবার তৎপরতা দেখেছে। এরই প্রবল বয়ানের বিপরীতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রত্যাশা, আবেগ ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে পশ্চিমা ও ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের ইসলামোফোবিক বয়ানের যুপকাষ্ঠে ফেলে দেশের সব সম্পদ ও নিয়ন্ত্রণ ভারতীয়দের হাতে তুলে দেয়ার ঘৃণ্য আয়োজন দেখেছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সেই বিশ্বাসঘাতকতার অন্ধকারে নতুন প্রজন্মের মধ্যে বেড়ে উঠেছে চব্বিশের জুলাইয়ের রক্তঝরা আত্মত্যাগ ও নতুন বাংলাদেশ গড়ার অসীম প্রত্যয়।

ভারতীয় আধিপত্যবাদের ছত্রছায়ায় গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসনে নাগরিকদের গুম-খুন, গণহত্যা, রাষ্ট্রের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও অর্থনৈতিক লুন্ঠনের মাধ্যমে দেশকে দেউলিয়া করে সম্পদ পাচারের সাথে সরকারের সব বাহিনী, আমলা ও আওয়ামী লীগ ও জোটের সব স্তরের নেতাকর্মীরা জড়িত ছিল। একেকটা সরকারি বাহিনী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপর পেটোয়া ও হন্তারক বাহিনী রূপে ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য নির্মম হয়ে ওঠার মধ্যেই হঠাৎ বারুদের মত ঝলসে ওঠা তারুণ্য লাখে লাখে রাজপথে নেমে আসা এবং গর্জনশীল রাইফেলের সামনে হাজারে হাজারে জীবন দিয়ে প্রতিরোধে এগিয়ে যাওয়ার অবিশ্বাস্য ঘটনা নতুন বাংলাদেশের বাস্তবতাকে অনিবার্য করে তুলেছে। চব্বিশের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ভিন্ন এক শঙ্কা ও সম্ভাবনার দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রসংস্কার ও নতুন গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, চীন-জাপানসহ পশ্চিমাবিশ্ব অর্ন্তবর্তী সরকারের পাশে দাঁড়ালেও ভারতের ষড়যন্ত্র, হুঙ্কার ও প্রপাগান্ডা অতীতের সব সীমা অতিক্রম করেছে। এটি শুধু বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকেই বাঁধাগ্রস্ত করছে না, তাদের সর্বাত্মক অসহযোগিতা, অবরোধ, আগ্রাসন, আক্রমণাত্মক তৎপরতা বাংলাদেশের অখ-তা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের উপর হুমকি সৃষ্টি করছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার এবং বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া কয়েক লাখ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং দেশে ঘাপটি মেরে থাকা দোসররা দেশের জন্য বড় অশুভ সংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। যে পরিবার, সরকার ও রাজনৈতিক দল ১৬ বছর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, দেশের সব বাহিনীকে দলীয় বাহিনীতে পরিণত করে একচ্ছত্র দানবীয় শক্তিতে পরিণত হওয়ার পরও নিরস্ত্র ছাত্রজনতার উত্থানের মুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, তারা আবার দেশে এসে ক্ষমতা দখল করবে, এমন স্বপ্ন যারা দেখে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। তবে বহি:শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে দেশের পঞ্চম বাহিনীর অপতৎপরতা দেশপ্রেমিক বাহিনীর জন্য অনেক বড় দুর্বলতা। ইরানে ইসরাইল-আমেরিকার হামলার সময় ৪৫ বছর আগে ইসলামী বিপ্লবকালে ইরান থেকে পালিয়ে যাওয়া রেজা পাহলবির পুত্র ও তার সমর্থকরা ইসরাইল আমেরিকার পক্ষাবলম্বন করেছে। তারা সেখানে রিজিম চেঞ্জ করে আবার পাহলবি বংশের ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখেছে। প্রথম আক্রমণেই ইরানের বেশ কয়েকজন র্শীষ সেনা কমান্ডার ও পরমানু বিজ্ঞানীর মৃত্যুর পেছনে স্থানীয় গুপ্তচরদের ভূমিকা স্পষ্ট। পতিত ও পালিয়ে যাওয়া রাজবংশের স্থানীয় সমর্থক, জায়নবাদি ইসরাইলের পেইড এজেন্ট হিসেবে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভারতীয় নাগরিক ইরানে গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে ধৃত ও মৃত্যুদ-ে দ-িত হচ্ছে। বাংলাদেশে স্বৈরাচারি সরকারের গুম-খুন, লুটপাটের সাথে আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ তৃণমূলের নেতাকর্মী সরাসরি জড়িত না থাকলেও তারা কখনো নিজ দলের নেতাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেনি। এমনকি যারা অপকর্মের সাথে জড়িত ছিল, দেশে-বিদেশে পালিয়ে থাকা সেসব নেতাকর্মীরাও তাদের কর্মকা-ের জন্য অনুতপ্ত নয়। দুইদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া দুটি অডিও-ভিডিওতে দেখা যায়, দীর্ঘদিন আত্মগোপণে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের সরকার এবং দেশের মানুষকে হুমকি দিচ্ছেন। ভারতে পালিয়ে থাকা ঢাকার একজন আওয়ামী লীগ নেতা আওয়ামী লীগ ভয়ঙ্করভাবে ফিরে আসার হুঙ্কার দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, ভারতে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা বাংলাদেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি ও গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে ভারতের দাবার গুটি হিসেবে কাজ করছে। পলাতক আওয়ামী লীগ ও কথিত সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের কল্পকাহিনী ছড়াতে মিথ্যা সংবাদ সৃষ্টি করতে পরিকল্পিতভাবে নিজেরাই ক্যামোফ্লেজ নাশকতার আশ্রয় নিচ্ছে। কুমিল্লার মুরাদনগরে হিন্দু নারীর পরকিয়ার ঘটনার ফাঁদ পেতে ভিডিও তৈরী করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের যোগসাজশের ঘটনা ইতিমধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার সাথে আওয়ামী লীগ এবং একশ্রেণীর হিন্দুর সংশ্লিষ্টতার যেসব ঘটনা ধরা পড়েছে, তারা মূলত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করেছে। অপরাধী, লুটেরাদের সংখ্যা শতকরা এক শতাংশেরও কম। রাজনৈতিক মতপাথর্ক্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অপরিহার্য অংশ। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি মূল্যবোধের রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটের রাজনীতি ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব যেন পলাতক স্বৈরাচারের দোসর ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রের অগ্নিতে ঘৃত সংযোগ না ঘটায়, সেদিকে সকলের সচেতন থাকা জরুরি। দেশের অগ্রযাত্রা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার প্রশ্নে দেশবিরোধী শক্তির ষড়ন্ত্র ও আস্ফালন রুখে দিতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার বিকল্প নেই। একটি জাতীয় ঐক্যের সনদ, রাষ্ট্রসংস্কার এবং ঘৃণ্য অপরাধিদের বিচার নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

সূত্র, ইনকিলাব