রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য ফরজে কিফায়া। রাজা শব্দটি প্রজা শব্দের বিপরীতার্থক। দেশ শাসনের অধিকার রাজার না প্রজার। যদি রাজার হয় তাহলে রাজতন্ত্র আর যদি প্রজার হয় তাহলে প্রজাতন্ত্র।

রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য ফরজে কিফায়া। রাজা শব্দটি প্রজা শব্দের বিপরীতার্থক। দেশ শাসনের অধিকার রাজার না প্রজার। যদি রাজার হয় তাহলে রাজতন্ত্র আর যদি প্রজার হয় তাহলে প্রজাতন্ত্র। রাজা মানে জালেম এবং প্রজা মানে মজলুম। প্রজার বিদ্রোহ থেকে রাজার বিলুপ্তি। প্রজাতন্ত্রের প্রজা অনুগত নয়,–বিদ্রোহী। জালেম ফ্যাসিবাদী হয়, মজলুম নয়। জালেম ৪৮ ও ৭৩ অনুচ্ছেদের সাংবিধানিক ক্ষমতা চায় মজলুমের ওপর জুলুম করার জন্য। জালেমের জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই। মজলুমের জন্য প্রয়োজন। প্রজাতন্ত্র নাগরিক সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতার মন্ত্র। খেলাফতের সঙ্গে গণতন্ত্র ও নাগরিক সার্বভৌমত্বের কোনো বিরোধ নেই।

ইংল্যান্ডের রাজার শিরশ্ছেদের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্র শব্দটির উদ্ভব। কাজেই প্রজাতন্ত্রের নাম সংস্কার; জাতীয় পতাকা পরিবর্তন, জাতীয় সংগীত পরিবর্তন ইত্যাদি কোনো মৌলিক সংস্কার নয়। গৌণ সংস্কার। এগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করলে আপনি আসল সংস্কারে কোনোদিন হাত দিতে পারবেন না। রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, পরিবারতন্ত্র, পীরতন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্র থেকে রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী ক্ষমতা তৈরি হয়। ফ্যাসিবাদী বিচারপতি, ফ্যাসিবাদী আমলা, ফ্যাসিবাদী জেনারেল ও ফ্যাসিবাদী অধ্যাপক ছাড়া কোনো দেশে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদ তৈরি হয় না। জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা জনগণের হাতেই চিরদিন থাকে। ব্যালটে একটি সিলের মাধ্যমে পাঁচ বছরের জন্য এটি কোনো এমপির কাছে হস্তান্তরিত হয় না। কাজেই কোনো এমপি যদি বিক্রি হয় তাহলে জনগণ তাকে তলব বা রিকল করতে পারে। সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের ম্যান্ডেট যায় এমপির কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে নয়। এখানে একটি নির্বাচনী এলাকার বাইরে প্রধানমন্ত্রীর কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। এমপিগিরি কোনো চাকরি নয় যে প্রধানমন্ত্রীর কলমের এক খোঁচায় তা নাই হয়ে যাবে। এ দেশে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী সম্ভাব্য এমপিকে মনোনয়ন দেয়। এটার পরিবর্তে প্রত্যেক দলে মনোনয়ন প্রদানের এমন নির্ধারিত নীতিমালা থাকতে হবে যেখানে দলীয় প্রধানের পছন্দ বা অপছন্দের কোনো ভূমিকা থাকবে না। সংবিধানের মাধ্যমে জনগণকে এ ক্ষমতা দেয়া হবে একটি মৌলিক সংস্কার। তাহলে এমপিরা আর ঘোড়ার মতো বিক্রি হওয়ার সুযোগ পাবে না এবং সংসদ আর কোনোদিন ঘোড়ার আস্তাবল হবে না। বিক্রি হওয়ার ভয়ে সব ঘোড়াকে সত্তর অনুচ্ছেদের মাধ্যমে একটি ঘোড়ার কাছে আগেভাগেই বিক্রি করে রাখাটা আদৌ কোনো গণতন্ত্র নয়। সেই একটি ঘোড়া যে অন্য কোনো দেশের কাছে বিক্রি হবে না তার কোনো গ্যারান্টি আছে? কেউ যদি কিনতে চায় তাহলে তাকে অনেকগুলো এমপি কিনতে হবে। ফলে কেনাকাটার ব্যাপারটা অবশ্যই জানাজানি হবে। গোপন রাখা আর কোনোমতেই সম্ভব হবে না। এমপি বিক্রি হলে দেশ বিক্রি হয় না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিক্রি হলে দেশ বিক্রি হয়ে যায়। আবার সেটা জানাজানিও হয় না। গোপনে ঘটে। সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর সমগ্র দেশবাসীর ভোটে নির্বাচিত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। কাজেই তাকে অবশ্যই এমপিদের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে এবং এমপিদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। অনাস্থা এবং দলের বিপক্ষে ভোট দেয়া একজন এমপি এবং সংসদের সহজাত ক্ষমতা। এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে সংসদ প্রধানমন্ত্রীকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত রাখবে, যা বিগত ৫৪ বছরে করা হয়নি। এটা না করতে পারলে দেশে কোনো সৎ মানুষ বিবেক নিয়ে কাজ করতে পারবে না। এটা কোনোমতেই কেড়ে নেয়া যাবে না। কাজেই সত্তর অনুচ্ছেদের সংশোধন রাষ্ট্রের এক নম্বর মৌলিক সংস্কার। ন্যাশনাল কনসেন্সাস কমিশন এটা করতে ব্যর্থ হলে জুলাই বিপ্লব অন্য বিপ্লবগুলোর মতো ব্যর্থ হবে।

সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদবলে দলীয় প্রধানমন্ত্রী, দলীয় বিচারপতি, দলীয় সচিব, দলীয় সাংবাদিক, দলীয় ভাইস চ্যান্সেলর, দলীয় অধ্যক্ষ, দলীয় ছাত্র, দলীয় শিক্ষক, দলীয় আইনজীবী, দলীয় কৃষক নেতা, দলীয় শ্রমিক নেতা, দলীয় প্রকৌশলী, দলীয় চিকিৎসক, দলীয় অন্যান্য পেশাজীবী ইত্যাদি নিয়োগ করে দলীয় হেজিমনি কায়েম করে। আবার দলীয় কর্মীদের ভোটে দলীয় প্রধান নির্বাচিত না হলে সেটি ব্যক্তি হেজিমনি থেকে ফ্যাসিবাদের দিকে চলে যেতে পারে। সর্বাত্মক দলীয়করণের এ বাংলাদেশী মডেল পশ্চিমা দেশগুলোয় নেই। ফলে এ দেশের মতো ভোট কারচুপির কোনো অবকাশ সেসব দেশে নেই। এই হেজিমনি থেকে দলীয় কর্মীরাও রেহাই পায় না। কারণ দলীয় কর্মীদের ভোটের মাধ্যমে দলের নেতা বা দলীয় প্রধান নির্বাচিত হয় না। ফলে দলগুলো চলে অনির্বাচিত নেতা দিয়ে এবং নেতাদের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য দলীয় কর্মীরা আন্দোলনের নামে বলির পাঁঠা হিসেবে রাজপথে ব্যবহৃত হয়। এজন্য সাংবিধানিক আইনের মাধ্যমে প্রত্যেক দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। সাংবিধানিক ও মানবাধিকার আদালতের মাধ্যমে নাগরিকদের মানবাধিকার এবং রাষ্ট্রের নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবের ঘাটতি আছে। সেখানে সাংবিধানিক ও মানবাধিকার আদালত গঠনের কোনো প্রস্তাব নেই। সংবিধান শুধু রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নয়। এটি রাষ্ট্রের একটি সর্বোচ্চ আইন, যা বলবৎযোগ্যতা ছাড়া অর্থহীন। এনসিসি সাংবিধানিক বা মানবাধিকার আদালতের কোনো বিকল্প হতে পারে না। রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ পদের নিয়োগ ও পদোন্নতিসংশ্লিষ্ট সাংবিধানিক কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল অর্থাৎ এনসিসির হাতে ন্যস্ত করতে হবে, যাতে টাকার বস্তা নিয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতির ধান্দাবাজির রাস্তা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়। এটা হবে রাষ্ট্রের দুই নম্বর মৌলিক সংস্কার। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু দলীয়, কাজেই ভারসাম্যের খাতিরে রাষ্ট্রপতিকে হতে হবে নির্দলীয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ইলেকটোরাল কলেজে সব নিবন্ধিত দল অন্তর্ভুক্ত থাকলে এনসিসিই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে আলাদা কোনো নির্বাচনকালীন সরকারের আর কোনো প্রয়োজন থাকছে না। স্থানীয় নির্বাচনেও দলীয় প্রভাব কাজ করে। কাজেই স্থানীয় নির্বাচনগুলোও নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে হতে হবে।

সরকার হবে দলীয় ও নির্দলীয় বা অদলীয় সরকারের সুষম সংমিশ্রণ। কেবিনেট, কেবিনেট কমিটি, মন্ত্রণালয়, স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলো ও সংসদ হবে দলীয় এবং সাংবিধানিক কমিশনগুলো হবে স্বতন্ত্র ও নির্দলীয়। সাংবিধানিক কমিশনগুলো তাদের কাজের জন্য মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে নয়, সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। ফলে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডে চমৎকার ভারসাম্য বিরাজ করবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বা কমিশনগুলো হতে পারে নিম্নরূপ:

১. উচ্চ শিক্ষা কমিশন, ২. নির্বাচন কমিশন, ৩. পাবলিক সার্ভিস কমিশন, ৪. জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন, ৫. মেডিকেল সার্ভিস কমিশন, ৬. প্রকৌশল সার্ভিস কমিশন, ৭. মহাহিসাব নিরীক্ষক অফিস, ৮. অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস, ৯. স্থানীয় সরকার কমিশন, ১০. দুর্নীতি ও অপরাধ দমন কমিশন, ১১. তথ্য ও পরিসংখ্যান কমিশন, ১২. মিলিটারি সার্ভিস কমিশন ও ১৩. সাংবিধানিক আদালত।

এসব সাংবিধানিক পদে ছাত্রদের মধ্য থেকে বাছাই করে নিয়োগ দিতে হবে এবং দলীয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ না করলে তা সম্ভব হবে না। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নয়, গণতন্ত্রের স্বার্থে দেশে থাকতে হবে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ছাত্ররাজনীতি। সব পেশাজীবী সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকশিত করতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনোক্রমেই এবং কোনো অজুহাতেই এমন কোনো অগণতান্ত্রিক মানবসম্পদ তৈরি করা যাবে না, যার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসতে পারে।

বাংলাদেশ রেভিনিউ সার্ভিস, বাংলাদেশ কাস্টমস সার্ভিস, বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টস সার্ভিস, বাংলাদেশ অডিট সার্ভিস এবং বাংলাদেশ ইনফরমেশন সার্ভিসও এক ধরনের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস। কাজেই গুরুত্ব বিবেচনায় দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এগুলো প্রশাসনে মার্জ হওয়াটা সমীচীন। ব্যাংকিং একটি ব্যবসা। বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়া আর কোনো ব্যাংক সরকারের হাতে থাকা সমীচীন নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাংবিধানিক কমিশনগুলোয় সিভিল সার্ভিসের বাইরে থেকে নিয়োগ দেয়া সমীচীন হবে না। প্রয়োজন হলে দেশের সব শিক্ষককে সিভিল সার্ভিসের আওতায় আনতে হবে। অসাধারণ মেধাবীদের কথা আলাদা। ব্যবসা বিনিয়োগ শক্তিশালী ও প্রতিযোগিতামূলক বেসরকারি খাতে রাখা সমীচীন। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস থেকে সচিব নিয়োগ করা হয়। অনেক ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের নীতিনির্ধারণী আমলা হিসেবে তাদের তৈরি করা হয়। পৃথিবীর কোনো দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ডাক্তার ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ইঞ্জিনিয়ার থাকে না। প্রশাসন সংস্কার কমিশন সচিব পদে পদোন্নতির জন্য সুপারিশের দায়িত্ব এসএসবির কাছ থেকে মন্ত্রিসভা কমিটির হাতে ন্যস্ত করার প্রস্তাব করেছে, যা দলীয়করণের মাত্রাকে আরো বাড়াবে। এটা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের হাতে রাখাটা সমীচীন। দলীয়করণ বন্ধ করতে হলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ ও পদোন্নতির একমাত্র কর্তৃপক্ষ হওয়া উচিত এনসিসি। ফ্রান্সের মতো বাংলাদেশেও আধা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে এবং রাষ্ট্রপতি সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হতে পারে। শিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে হলে সব সিলেবাস ও শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব উচ্চ শিক্ষা কমিশনকে ন্যস্ত করা যেতে পারে।

রাষ্ট্র সংস্কার ছাড়া নষ্ট রাজনীতির আর কোনো চিকিৎসা দেশে নেই। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে একটি অবিপ্লবী উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে বিপ্লবী সরকারের যাত্রা শুরু। এ সরকারের মধ্যে জাতীয় সরকারের মতো কর্মচাঞ্চল্য নেই। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ১৬৬ দফা রাষ্ট্র সংস্কার জনগণের কাছে বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক লম্বা এবং ভারী হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও আমলাতন্ত্রে নেই কোনো রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের ঢেউ। অনেক উপদেষ্টার আমলে বিপ্লবী সরকারের কোনো আলামত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই চুপচাপ আছে পরবর্তী সুবিধার টোপ গেলার ধান্দায়। তাদের মুখে নেই কোনো সংস্কারের বাণী। নেই সংস্কারের বাণী নিয়ে দেশের সব শিক্ষিত নাগরিকের ঘরের দরজায় যাওয়ার কোনো ব্যাপক উদ্যোগ। অথচ ভাগ্যগুণে এ দেশ পেয়েছে ড. ইউনূসের মতো একজন বিশ্বখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক। তথাপি হেলায় হারানো হচ্ছে প্রতিটি সেকেন্ড ও মিনিট। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কারের এমন সুযোগ দ্বিতীয়বার নাও পেতে পারে।

মু. আবদুল হাকিম: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

সূত্র, বণিক বার্তা