২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য ঘটনা। এটি কেবল গণপ্রতিবাদের প্রকাশ নয়, রাজনীতিতে এক নতুন কল্পনা ও প্রত্যাশার দ্বারও খুলে দেয়।
২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য ঘটনা। এটি কেবল গণপ্রতিবাদের প্রকাশ নয়, রাজনীতিতে এক নতুন কল্পনা ও প্রত্যাশার দ্বারও খুলে দেয়। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ক্ল্যাসিক্যাল অর্থে বিপ্লব ছিল না। এটি রাষ্ট্রযন্ত্রকে মৌলিকভাবে ভেঙে দেয়নি বা একটি সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেনি। বরং এটি ছিল একটি গণ-অভ্যুত্থান, যাতে কিছু বিপ্লবী উপাদান ছিল—বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যান্য গণ-আন্দোলন বা অভ্যুথান থেকে এর মাত্রা ও তীব্রতার দিক থেকে স্বতন্ত্র। এ অর্থে ‘বিপ্লব’" শব্দটি এখানে একটি টেকনিক্যাল বর্গ হিসেবে নয়, বরং পূর্ববর্তী গণ-আন্দোলন বা প্রতিবাদ থেকে এর স্বাতন্ত্র্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, এর প্রতীকী তাৎপর্য এবং যে রাজনৈতিক কল্পনা এটি মুক্ত করেছে তার ভিত্তিতে।
এক বছর পর, এ বিপ্লব-উত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতা এখনো তরল, জটিল ও বিকাশমান। প্রাথমিক উদ্দীপনা স্তিমিত হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ভাষ্য, ক্ষমতার বিন্যাস এবং প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে, প্রশ্ন করছে।
বিপ্লব-উত্তর রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে একটি অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব—আন্দোলন গণতান্ত্রিক বৈধতার গভীর সংকট উন্মোচন করলেও তা অবিলম্বে শাসন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে পারেনি। বরং রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রের আংশিক পুনর্বিন্যাস ঘটিয়েছে। গণ-অভ্যুথানে অংশগ্রহণকারীদের ত্যাগ, তীব্রতা ও স্বতঃস্ফূর্ততায় শেখ হাসিনার প্রচণ্ড কেন্দ্রীভূত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান হয়েছে, যার হাত ধরে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার জনআকাঙ্ক্ষায় সাড়া দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছে—সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি, রাজবন্দিদের নির্বাচিতভাবে মুক্তি এবং জনসমাজের সঙ্গে নতুন করে সংলাপ। তবে অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, এসব পদক্ষেপ মূলত তাৎক্ষণিক চাপ সামলানোর কৌশল, যা কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির মৌল কাঠামো অক্ষত রেখেছে।
রাজনৈতিক রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি ও সীমাবদ্ধতা
প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও এ গণ-অভ্যুত্থান নতুন কোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। পুরনো রাজনৈতিক দলগুলো—বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি—নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের প্রতি সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছে। দলগুলোর কাঠামো এখনো অস্বচ্ছ, গণতান্ত্রিক ঘাটতি বহাল আর আয়ের ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা অনুপস্থিত। দখলবাজি ও চাঁদাবাজি এখনো স্বাভাবিক চর্চা হিসেবে চলছে। এ গভীরে গেঁথে যাওয়া অভ্যাসগুলো—যেগুলোকে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিল—এখনো টিকে আছে। এমনকি বহুল প্রত্যাশিত নতুন রাজনৈতিক শক্তি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এখনো নিজেদের কার্যকর বিকল্প শক্তি হিসেবে প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছে; বরং তারা প্রচলিত কর্মসূচি, পুরনো বয়ান ও সাংগঠনিক চর্চার ওপরই নির্ভর করছে।
গ্রামশিয়ানের পরিভাষায়, ‘ওয়ার অব পজিশন’—অর্থাৎ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য পরিবর্তনের দীর্ঘ সংগ্রাম—এখনো জেতা যায়নি। গণ-অভ্যুত্থান পুরনো ব্যবস্থার মুখোশে একটি ফাটল ধরাতে পেরেছে বটে, কিন্তু সেটিকে প্রতিস্থাপন করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান, বয়ান বা সাংগঠনিক ভিত্তি দখল করতে পারেনি। আধিপত্যশীল গোষ্ঠী মূলত অক্ষতই রয়ে গেছে, যদিও সাময়িকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়েছে।
বিভক্তি ও মেরুকরণ
রাজনৈতিক পরিসর এখন তীব্রভাবে উদারপন্থী ও রক্ষণশীল শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। ডানপন্থী দল ও শক্তিগুলো সাম্প্রতিক কয়েক দশকের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে উদার ও প্রগতিশীল ক্ষেত্রগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে সংকুচিত হয়েছে। যে বিষয়গুলো একসময় প্রগতিশীল রাজনীতির কেন্দ্রীয় এজেন্ডায় ছিল—লিঙ্গ সমতা, আদিবাসী অধিকার, শ্রমিক সুরক্ষা—সেগুলো এখন মূলধারার রাজনৈতিক আলোচনায় প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। এ এজেন্ডা সংকুচিত হওয়া শুধু দলীয় রাজনীতির আদর্শিক পুনর্বিন্যাসের প্রতিফলন নয়, বরং রাজনৈতিক পরিসরের সংকোচনেরও চিহ্ন—কার্ল স্মিটের ভাষায়, সেই ক্ষেত্র যেখানে সমাজের মৌলিক মূল্যবোধ ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায়। এখন অধিকারের পরিসর বাড়ানোর সংগ্রাম দুর্বল হয়ে পড়েছে; বরং তা বেশি আবর্তিত হচ্ছে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা বা তা চ্যালেঞ্জ করার লড়াইয়ে।
এলিটদের মধ্যে ঐকমত্যের ব্যর্থতা
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে একটি সফল গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ন্যূনতম নিয়মকানুন বিষয়ে এলিটদের মধ্যে ঐকমত্য অপরিহার্য। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা সংলাপ সত্ত্বেও বড় দলগুলোর মধ্যে কোনো যৌথ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়নি। পারস্পরিক অবিশ্বাস, স্বল্পমেয়াদি নির্বাচনী হিসাবনিকাশ এবং দলগত প্রতিযোগিতা এমন একটি সমঝোতায় পৌঁছার প্রক্রিয়াকে থমকে দিয়েছে, যা এই রূপান্তরমুখী সময়কে স্থিতিশীল করতে পারত। এ ঐকমত্যের অনুপস্থিতি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় (যেমন প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা বা পুলিশ প্রশাসন) অনিশ্চয়তা ও অদক্ষতা অব্যাহত রয়েছে।
রাজনীতিতে নতুন ভাষ্য, নতুন শক্তি
সম্ভবত অভ্যুত্থানের সবচেয়ে স্থায়ী উত্তরাধিকার হলো রাজনৈতিক পরিসরের সম্প্রসারণ। নতুন বয়ান, নতুন কর্মসূচি এবং নতুন রাজনৈতিক শক্তি—বিশেষ করে তরুণদের নেতৃত্বাধীন সমষ্টি, ডিজিটাল অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক এবং স্থানীয় প্রতিরোধ সংগঠন—জনপরিসরে প্রবেশ করেছে। এগুলো রাষ্ট্র বনাম বিরোধী—এ প্রচলিত দ্বিমাত্রিক রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করছে। যদিও মতাদর্শ বা কাঠামোগত দিক থেকে এগুলো এখনো সংঘবদ্ধ নয়, তবুও এগুলো অংশগ্রহণমূলক, জবাবদিহিমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির প্রতি এক প্রবল আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত দেয়। এমনকি নিজেদের বিভক্ত অবস্থায়ও এ শক্তিগুলো এ ধারণাকে মজবুত করেছে যে বাংলাদেশের মানুষ কেবল শাসিত প্রজা নয়, বরং নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা ও ক্ষমতার অধিকারী নাগরিক।
অন্যদিকে প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোও বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। একদিকে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক আপস ও তৃণমূলের সঙ্গে দুর্বল সংযোগ তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করেছে। অন্যদিকে জুলাই আন্দোলন তাদের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে দিয়েছে—তারা আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে বা প্রভাবিত করতেও ব্যর্থ হয়েছে। ফলে অনেক দল এখন প্রান্তিক হয়ে পড়েছে বা উদীয়মান নাগরিক শক্তির সঙ্গে অস্বস্তিকর সমঝোতায় যাওয়ার চাপে পড়েছে, যাদের চাহিদা ও ভাষা তারা পুরোপুরি বোঝে না। তবে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো যদি এ নাগরিক শক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে ও তাদের বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আবারো কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা উন্মুক্ত থেকে যাবে, আর এ গণ-অভ্যুত্থান, গ্রামশির ভাষায়, আরেকটি ‘প্যাসিভ রেভল্যুশন’ হিসেবে চিহ্নিত হবে, যেখানে ওপর ওপর কিছু সংস্কারের আড়ালে পুরনো ক্ষমতার কাঠামো অক্ষুণ্ন থাকে।
দ্বিধান্বিত রাষ্ট্র
এ নতুন রাজনীতিতে রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র—কিছু প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সংস্কারের ভাষা গ্রহণ করেছে, কিন্তু প্রচলিত দমনমূলক সংস্থা ও নিরাপত্তা কাঠামো অক্ষত রয়েছে। ভিন্নমত পর্যবেক্ষণ অব্যাহত। যদিও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতার পরিসর বেড়েছে। ফলে আমরা এমন এক রাষ্ট্রকে দেখছি, যা পুরোপুরি দমনমূলক নয়, কিন্তু প্রকৃত রাজনৈতিক পরিসর উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্যও প্রস্তুত নয়।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও প্রতিক্রিয়া সতর্ক ছিল। উন্নয়ন সহযোগী ও কূটনৈতিক অংশীদারেরা সংস্কারের আহ্বানকে স্বাগত জানালেও শিগগিরই তারা স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরে গেছে। এ নীরবতা সরকারকে স্থিতিশীলতা ও ধীর পরিবর্তনের ন্যারেটিভ প্রচারে উৎসাহিত করেছে, যা প্রকৃত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথকে অনিশ্চিত করে তুলেছে।
২০২৬-এর পথে
বাংলাদেশ এখন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ নির্বাচন যেন কেবল নির্বাচনী ক্যালেন্ডার রিসেট করার অনুশীলনে সীমাবদ্ধ না থেকে অর্থবহ হয়, সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে শাসন ব্যবস্থায়, দলীয় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রে এবং বৈচিত্র্যের সুরক্ষায় মৌলিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়ের মূল্যবোধগুলোকে রাজনৈতিক প্রকল্পের প্রান্তিক নয়, বরং কেন্দ্রে স্থাপন করতে হবে। নইলে এ নির্বাচনও এক ফাঁপা গণতান্ত্রিক খোলসের ভেতর পরিচালিত নিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতার আরেকটি আচার হয়ে পড়ার ঝুঁকি বহন করবে।
শেষ কথার আগের কথা
জুলাই বিপ্লব নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো হয়নি। তার পরও এই এক বছর পরে এসে সব মিলিয়ে বলা যায় যে জুলাই-উত্তর রাজনীতি এক ধরনের অস্পষ্টতায় আচ্ছন্ন। বিপ্লবের তাৎক্ষণিক উত্তাপ কমে এসেছে, কিন্তু যে রাজনৈতিক মাটি কেঁপে উঠেছিল, তা এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল নয়। এটি রাজনৈতিক কেন্দ্রকে অস্থিতিশীল করেছে, কিন্তু তার জায়গায় বিকল্প কিছু স্থাপন করতে পারেনি; পুরনো দলীয় কাঠামোর ভঙ্গুরতা প্রকাশ করেছে, কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে; রাজনৈতিক কল্পনাশক্তিকে প্রসারিত করেছে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বড় অংশকে অপরিবর্তিত রেখেছে। ক্ষমতার কেন্দ্র দুর্বল হয়েছে কিন্তু অক্ষত, প্রান্তের শক্তি উদ্দীপ্ত কিন্তু খণ্ডিত। এ মুহূর্ত গণতান্ত্রিক গভীরতায় রূপ নেবে নাকি পুরনো কাঠামোই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে—তা নির্ভর করছে উদীয়মান শক্তিগুলোর সংগঠন ক্ষমতা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের বাস্তব অগ্রগতি এবং আস্থাভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক, জবাবদিহিমূলক এক নতুন সামাজিক চুক্তি কল্পনা ও বাস্তবায়নের সক্ষমতার ওপর।
কাজী মারুফুল ইসলাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য।