বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্প্রতি সব ডিগ্রি প্রদানকারী প্রোগ্রামের জন্য বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত আউটকাম-বেজড এডুকেশন (ওবিই) পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। তবে উদাহরণ আছে, কিছু দেশে এ পদ্ধতির তড়িঘড়ি বাস্তবায়নের ফলে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত হয়নি। যদি পরিকল্পনাহীন ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া ওবিই কার্যকর করা হয়, তবে বাংলাদেশও একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।

১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের কে-১২ বিদ্যালয়গুলোয় ওবিই প্রথম চালু করা হয়, তখন এটি অভিভাবক ও স্কুল কর্তৃপক্ষের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ও ওবিইর পথপ্রদর্শক অধ্যাপক উইলিয়াম স্প্যাডি তার মূল মডেলকে আরো পরিমার্জন করেন। তার এ সংস্কার ওবিই আন্দোলনের ভিত্তিকে আরো সুসংহত করে, যেখানে তিনি কার্যকর বাস্তবায়ন ও শিক্ষার্থীদের উন্নত ফলাফলের জন্য কয়েকটি মূলনীতি যুক্ত করেন—যেমন স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ, কারিকুলাম উন্নয়নে টপ-ডাউন পদ্ধতির প্রয়োগ, উচ্চ প্রত্যাশা, এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বিস্তৃত সুযোগ সৃষ্টি।

ওবিই শুধু একটি শিক্ষণ মডেল নয়; এটি শিক্ষার ধারণাগত কাঠামোর একটি মৌলিক রূপান্তরকে প্রতিফলিত করে। যেখানে প্রথাগত শিক্ষা (টিই) পদ্ধতি জ্ঞানকে স্থির ও সার্বজনীন বলে ধরে নেয়, সেখানে ওবিই জ্ঞানকে প্রেক্ষাপটনির্ভর, বিকাশমান এবং প্রয়োগমুখী হিসেবে বিবেচনা করে, যা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বাস্তবতায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

টিই পদ্ধতিতে শিক্ষকরা মূলত নির্দিষ্ট কোর্সবিষয়ক জ্ঞান প্রদান করেন, যা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় সফলতার জন্য মুখস্থ নির্ভরশীল করে তোলে। অপরদিকে, ওবিই শিক্ষার্থীদের শেখার ফলাফলের ওপর গুরুত্ব দেয়—তারা যা শিখছে, তা বাস্তবে কতটা প্রয়োগ করতে পারছে, সেটিই মুখ্য। এ দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার উদ্দেশ্য, শিক্ষকের ভূমিকা এবং জ্ঞানের প্রকৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপন করে।

ওবিই আমাদের জন্য একটি নতুন শিক্ষাগত পদ্ধতি, যা সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এর মূল নীতিগুলো গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। পাশাপাশি পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও মূল্যায়নে কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ অপরিহার্য। শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করতে এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে Continuous Quality Improvement (CQI)-এর কার্যকর ও ধারাবাহিক বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যদিকে, টিই পদ্ধতিতে মানোন্নয়ন কোনো ধারাবাহিক প্রক্রিয়া নয়। এতে পাঠ্যক্রম পরিবর্তন সাধারণত ধীরগতিতে হয় এবং অ্যাক্রেডিটেশন প্রয়োজনীয়তা বা বিষয়বস্তুর অগ্রগতির মতো বাহ্যিক কারণ দ্বারা পরিচালিত হয়। ফলস্বরূপ এটি শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনের লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয় না, বরং কাঠামোগত বাধ্যবাধকতার ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়।

ওবিইর ভিত্তি একটি টেলিওলজিক্যাল (লক্ষ্যভিত্তিক) শিক্ষাদর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটি ব্যাকওয়ার্ড ডিজাইন পদ্ধতি অনুসরণ করে, যেখানে শিক্ষার সূচনা হয় স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত আউটকামস নির্ধারণের মাধ্যমে। এরপর পাঠ্যক্রম, শিক্ষণ পদ্ধতি এবং মূল্যায়ন কৌশলগুলো সেই নির্ধারিত আউটকাম অর্জনের জন্য পরিকল্পিতভাবে গঠিত হয়।

এ দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহ্যবাহী Essentialist Education-এর সঙ্গে মৌলিকভাবে ভিন্ন, যেখানে শিক্ষা একটি স্থির জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচিত হয় এবং শিক্ষকের ভূমিকা মূলত সেই জ্ঞান হস্তান্তরে সীমাবদ্ধ থাকে। ওবিই এর বিপরীতে শেখার প্রক্রিয়াকে গঠনমূলক ও প্রাসঙ্গিক করার ওপর গুরুত্ব দেয়, যাতে শিক্ষার্থীরা অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারে।

ওবিই-ভিত্তিক পাঠ্যক্রম প্রণয়নের সফলতা নির্ভর করে ডিগ্রি প্রদানকারী বিভাগের দক্ষ পরিকল্পনার ওপর, যেখানে প্রধান তিনটি উপাদানগুলো হচ্ছে Program Educational Objectives (PEOs), Program Learning Outcomes (PLOs), এবং Course Learning Outcomes (CLOs)। PEOs স্নাতকদের জন্য তিন থেকে পাঁচ বছর পর অর্জিত লক্ষ্য নির্ধারণ করে। PLOs শিক্ষার্থীদের একাডেমিক প্রোগ্রাম সম্পন্ন করার পর অর্জিত সামগ্রিক দক্ষতা নির্দেশ করে আর CLOs নির্দিষ্ট করে যে শিক্ষার্থীরা একক কোর্স থেকে কোনো জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করবে। CLOs মূলত Bloom’s Taxonomy অনুসরণ করে গঠন করা হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা মৌলিক জ্ঞান অর্জন থেকে শুরু করে উচ্চতর কগনিটিভ দক্ষতা—যেমন বিশ্লেষণ, সংশ্লেষ, মূল্যায়ন এবং সমস্যা সমাধান—উন্নয়ন করতে পারে। PLOs এবং CLOs-এর মধ্যে একটি সুগঠিত ম্যাপিং প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে যে প্রতিটি কোর্স প্রোগ্রামের সামগ্রিক লক্ষ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে সংযোগ স্থাপন করে। তাই শিক্ষার্থীরা তাদের গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার আগেই প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে, এটি নিশ্চিত করতে PLOs এবং CLOs-এর যথাযথ সংযোগ স্থাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, CLOs এবং PLOs-এর অর্জন পরিমাপের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্ভরযোগ্য রুব্রিকস ও মূল্যায়ন পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে।

মূল্যায়ন এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে উন্নত করা অত্যাবশ্যক, যাতে PLOs ও PEOs-এর অর্জন বৃদ্ধি পায়। ওবিইর ক্ষেত্রে ধারাবাহিক গুণগত উন্নয়ন (CQI) শুধু একটি পরিমাপের সরঞ্জাম নয়; এটি একটি সিস্টেম্যাটিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া, যা একাডেমিক প্রোগ্রামগুলোকে প্রাসঙ্গিক, কার্যকর এবং পরিবর্তনশীল শিক্ষা ও শিল্পের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে সহায়তা করে। নিয়মিত মনিটরিং ও পরিমার্জনের মাধ্যমে CQI নিশ্চিত করে যে শিক্ষা মান উচ্চ থাকে এবং শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হয়।

আজকের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। এ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে দেশটি ধীরে ধীরে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওবিইকে একটি প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত সংস্কার হিসেবে গ্রহণ করেছে। ওবিইর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে এডুকেশন মিনিস্ট্রি ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে (ইউজিসি) দায়িত্ব নিয়ে কার্যকর সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। সফল বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।

ওবিই শুধু একটি শিক্ষাদর্শনের পরিবর্তন নয়, এটি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাকে আরো দক্ষতাভিত্তিক, বাস্তবমুখী ও কার্যকর করার একটি নতুন দিক উন্মোচন করছে।

এম এম শহিদুল হাসান: ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক ভিসি, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি;

প্রফেসর (অব.), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র , বণিক বার্তা