জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সারাদেশে পদযাত্রা ও পথসভা করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জের পদযাত্রাটি ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ শিরোনামে ঘোষিত হয়। উত্তরের প্রায় সবগুলো জেলায় শান্তিপূর্ণ পদযাত্রা কর্মসূচি শেষে গোপালগঞ্জে এনসিপির প্রোগ্রামে ভয়ঙ্কর হামলা চালায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা সভামঞ্চে পৌঁছার আগেই সকাল থেকে গোপালগঞ্জের চৌরঙ্গি মোড়ে এনসিপির সভামঞ্চ একাধিকবার হামলার শিকার হয়। নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে হাসনাত আব্দুল্লাহ, সার্জিস আলম, আখতার হোসেনসহ কেন্দ্রীয় নেতারা গোপালগঞ্জে আসার পথে বিভিন্ন স্থানে বাধা ও আক্রমণের শিকার হওয়া সত্ত্বেও দুপুর ২টা নাগাদ সভামঞ্চে পৌঁছে সভা শেষ করে ফেরার পথে শত শত সশস্ত্র ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীর আক্রমণের শিকার হন। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র, ইটপাটকেল, মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ, আগ্নেয়াস্ত্রের তা-ব মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হিমশিম খেতে হয়। পুলিশ-বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর অ্যাকশনে সত্ত্বেও রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া গোপালগঞ্জ শহর থেকে এনসিপি নেতাদের নিরাপদে সরিয়ে আনতে সেনাবাহিনীর এপিসি ব্যবহার করা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে অন্তত চারজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এনসিপি ও সন্ত্রাসী গ্রুপের বেশ কিছু লোক আহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে স্থানীয় প্রশাসন গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করেছে।
গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের উপর গণহত্যাকারী পতিত স্বৈরাচারের দোসর নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীর ন্যক্কারজনক হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছে। দেশের কোথাও কোথাও স্থানীয় নেতাকর্মীরা রাস্তায় ব্লকেড সৃষ্টি করলে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। এনসিপি নেতাদের উপর হামলার প্রতিবাদে বিএনপি, জামায়াতসহ জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থক ও অংশগ্রহণকারী দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে তাৎক্ষণিক বিবৃতিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ মিছিল করতে দেখা গেছে। মিটফোর্ডের সোহাগ হত্যাকা-, খুলনায় যুবদল নেতা হত্যাসহ কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে এক ধরনের ব্লেইম-গেম বা কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটলেও গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের উপর হামলার ঘটনায় সব পক্ষকে অভিন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে শামিল হতে দেখা যাচ্ছে। বোঝা যায়, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের প্রশ্নে জুলাইতে অভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে তেমন কোনো মতপার্থক্য নেই। তবে গোপালগঞ্জের ঘটনাকে ঘিরে দেশে এক ধরনের ঐকমত্য থাকা সত্ত্বেও এ নিয়ে পানি ঘোলা করার নানাবিধ আলামতও ফুটে উঠেছে। গোপালগঞ্জে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাথে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সঙ্ঘাতের প্রচুর ভুয়া ছবি ছড়িয়ে দেশ-বিদেশে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত করছে আওয়ামী দোসররা। পক্ষান্তরে এনসিপি, জামায়াতসহ কিছু রাজনৈতিক দলকে সংস্কার, বিচারসহ নানা দাবি-দাওয়া সামনে রাখার পাশাপাশি নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ না থাকার অজুহাতে নির্বাচন আরো পিছিয়ে দেয়ার পক্ষে কথা বলতে দেখা গেছে। গোপালগঞ্জের ঘটনার পর তারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অজুহাত তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচি নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষত জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের শাহাদত দিবসকে জাতীয়ভাবে পালনের উদ্যোগে এনসিপি নিষ্পৃহ থাকতে পারে না। দিবসটি পালন উপলক্ষে ঢাকায় এবং রংপুরে যথাযোগ্য মর্যাদায় সাড়ম্বরে ভিন্নমাত্রার অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করতে পারত এনসিপি। তা না করে গোপালগঞ্জের পদযাত্রাতে মার্চ টু গোপালগঞ্জ ঘোষণা দিয়ে যে জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল তা নিয়ে মহল থেকে নানাবিধ প্রচারণা-প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে গোপালগঞ্জকে একটি ভীতিকর-উত্তপ্ত জনপদে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষত শেখ মুজিবের সমাধিসৌধ ভাঙার গুজব ছড়িয়ে সারা দিনে অনেকটা একতরফা সংঘর্ষ ও সভা শেষ করে ফেরার পথে এনসিপি নেতাদের হত্যার উদ্দেশে আক্রমণের পেছনে বড় ধরনের দুরভিসন্ধি ছিল বলে আঁচ করা যায়।
গোপালগঞ্জ যেমন বাংলাদেশের বাইরে নয়, তেমনি গোপালগঞ্জের অতীত ইতিহাসও এনসিপি নেতা ও সরকারি প্রশাসনের ধর্তব্যে রাখা দরকার ছিল। যেখানে বিগত সাড়ে চার দশকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়া গোপালগঞ্জ সফরে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেখানে এনসিপি নেতাদের অতি সাহসী রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণের আগে সামগ্রিক বিষয়ে সচেতনতা ও প্রস্তুতি থাকা দরকার থাকলেও বুধবার তা ছিল অনুপস্থিত। অন্যদিকে সরকারের প্রশাসনও এনসিপির নেতাদের নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মনে রাখা দরকার ছিল, তারা শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নেতাই নন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বীরও বটে। তাদের নিরাপত্তায় উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। যথাযথ গোয়েন্দা নজরদারি ও উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিলে মূল্যবান চারটি প্রাণের মৃত্যু ঘটত না।। প্রতিটি প্রাণই মূল্যবান। তাৎক্ষণিকভাবে হেলিকপ্টার যোগে এনসিপি নেতাদের উদ্ধার না করে এপিসি দিয়ে সড়ক পথে উদ্ধারের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এমনিতেই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যেও এক ধরনের নীরব প্রতিক্রিয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় গোপালগঞ্জের ঘটনাকে যেন পক্ষগুলো নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে, সেদিকে সচেতন মহলের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচাল করার অপ-উদ্দেশ্য থাকতে পারে এ ঘটনা সৃষ্টির পেছনে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার অবকাশ রাখে। গোপালগঞ্জের ঘটনা সবার চোখ খুলে দিয়েছে। সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পতিত স্বৈরাচারের দোসর পলাতক সন্ত্রাসীরা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইবে, এটিই স্বাভাবিক। গোপালগঞ্জে তা-ব সৃষ্টির সাথে জড়িত প্রত্যেককে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে গোপালগঞ্জসহ দেশের সর্বত্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়ে ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি বন্ধে সেনাবাহিনী সহায়তায় সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চিরুনি অভিযান যেন শুধু কাগুজে বাঘ না হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশে শান্তি, নিরাপত্তা ও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।