সেনাবাহিনীর বিমান প্রকিউরমেন্ট ও টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনের সঙ্গে আমি নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলাম। সেনাবাহিনীর প্রকিউরমেন্টের প্রত্যেকটা সেগমেন্ট কিন্তু আলাদা এবং খুব নিখুঁতভাবে করা হয়।

কর্নেল মো. সোহেল রানা, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও পাইলট। ১৯৯০ সালে ২৩ বিএমএ লং কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে এবং ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আর্মি এভিয়েশনে যোগ দেন। বিমান চালনার ওপর দেশে-বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এছাড়া ফ্লাইট সেফটি এবং এয়ারক্রাফট অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ফিক্সড উইং পাইলট এবং প্রশিক্ষক হিসেবে প্রায় দুই যুগ আর্মি এভিয়েশনে কর্মরত ছিলেন। তিনি কুয়েত, কঙ্গো ও লাইবেরিয়ায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনেও অংশ নিয়েছেন। ২০২৩ সালে অবসরের পর একটি বিদেশী কোম্পানিতে পাইলট হিসেবে কর্মরত আছেন। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা, দেশের এয়ারক্রাফট ও এয়ারবেজ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবরিনা স্বর্ণা

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে সম্প্রতি বিধ্বস্ত হয়েছে যুদ্ধবিমান এফ-৭বিজিআই। শুরুতেই এ ঘটনা ঘিরে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।

প্রথমত, বিমান দুর্ঘটনায় পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের মৃত্যুতে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। আমি যে ক্যাডেট কলেজে পড়ালেখা করেছি, তিনিও একই ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য ৩৩ বছর হলেও তাকে আত্মার আত্মীয় মনে হয়। দ্বিতীয়ত, যেসব শিশু বাসার পর দ্বিতীয় নিরাপদ স্থান স্কুলে খেলাধুলা করছিল, কেউ পড়ছিল বা কেউ বাসায় যাবে—সেই সময় মৃত্যু তাদের দুয়ারে আকস্মিকভাবে দাঁড়ায়! এমন অভাবনীয় মৃত্যু খুব কম দেখা যায়, যেটা দেশ-বিদেশের সবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করেছে। তাদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দোয়া সবসময় থাকবে।

আরেকটা কথা বলা দরকার, কোনো বিমান দুর্ঘটনা হলে আগেই মন্তব্য করতে নেই, যেটাকে অবিবেচনাপ্রসূত মন্তব্য বলে। বিমান নানা কারণে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে, আবহাওয়াজনিত জটিলতা, যান্ত্রিক গোলযোগ, নিয়ন্ত্রণজনিত বিষয় থাকে। ফলে না জেনে কিছু বললে পুরো ব্যক্তি বা সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি প্রশিক্ষণ বিমান নয়, যুদ্ধবিমান ছিল। এটি যেকোনো যুদ্ধ বা মিশনের জন্য প্রস্তুত ছিল। তবে যখন অপারেশনে থাকে না তখন প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়। যে পাইলট ছিলেন তিনি একাকী বিমান চালানোয় দক্ষতা অর্জন করেছেন এবং তিনি সেদিন ফ্লাইংয়ে ছিলেন। যেকোনো মিশনে বা প্রশিক্ষণে যাওয়ার আগে সক্ষমতা ও কারিগরি দিক পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করা হয়। সেই পরীক্ষা করেই ইঞ্জিনিয়াররা পাইলটের কাছে বিমান হস্তান্তর করেন। পাইলট যখন ফ্লাইংয়ে যান তখন সব ধরনের পরীক্ষা করে যান। আমরা বলতে পারি, পাইলট একদম বোনাফাইড ডিউটিতে ছিলেন এবং তার সঙ্গে যে যুদ্ধবিমানটি দেয়া হয়েছে সেটি ফ্লাইংয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু আকাশে গিয়ে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়, যেমন হাইড্রোলিক কিংবা ইলেকট্রিক ফেইল হতে পারে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে ইঞ্জিন ফেলও হতে পারে। বিধ্বস্ত বিমানটি এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট এবং যুদ্ধবিমান ছিল। ফলে ইঞ্জিন ফেল করলে এটা পাথরের মতো পড়ে যায় এবং নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আমি যতদূর জানতে পেরেছি, কারিগরি ত্রুটি হওয়ায় পাইলট বিমানটিকে রানওয়েতে আনার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা করতে পারেননি। তার আগেই বিমানটি ভূপতিত হয় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে। সব মিলিয়ে এটা একটি যান্ত্রিক দুর্ঘটনা, যা তদন্তের মাধ্যমে বের হবে। কারণ আবহাওয়া ভালো ছিল ও ট্রাফিক ক্লিয়ার ছিল।

গত তিন দশকে আমরা ২৭টি বিমান দুর্ঘটনা দেখেছি। কেন বারবার বিমান দুর্ঘটনা ঘটছে। এর কারণ কী এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি মোকাবেলায় কেন যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারছি না?

আপনাকে সবসময় বিশ্বাস করতে হবে যে ফ্লাইং একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এ ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, বিশেষত সিভিল এভিয়েশন সর্বোচ্চ চেষ্টা করে, যাতে একটি বিমান নিখুঁতভাবে নিরাপত্তা মেনেই নিরাপদে ফ্লাই করে।

একটা বিমান দুর্ঘটনা ঘটলে তার রিপোর্ট পেতে এক-দুই বছর পার হয়ে যায়। আমরা যদি গত তিন দশকের বিভিন্ন যুদ্ধবিমানের দুর্ঘটনা নিয়ে পরিসংখ্যান নিই, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয়ত, আবহাওয়ার কারণে। তৃতীয়ত, পাখির ধাক্কার কারণে। চতুর্থত, পাইলটের আত্মহত্যার প্রবণতা। পাইলটের যদি আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে তাহলেও বিমান দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ রকম চার-পাঁচটি ঘটনা আছে।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাইলটদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। এটা একটা জটিল জগৎ। যেখানে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে এবং বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আছে, নিজস্ব কমপ্লায়েন্স ও নিজস্ব বাজেট আছে। কেউ বাজেট ও কমপ্লায়েন্স মেইনটেইন করে এবং কেউ করে না। এর মধ্য থেকে সবার উদ্দেশ্য একটাই—সেটি নিরাপদ বিমান ভ্রমণ।

সম্প্রতি আমাদের যে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে সেটি চীনা নির্মিত। অনেকেই বলছেন এটি অনেক পুরনো বিমান। ২০১৩ সালে চীন এর উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। এরই মধ্যে এ মডেলের বিমান নিষিদ্ধ করা হয়েছে অনেক দেশে। বাংলাদেশ কেন তাহলে এ বিমান এখনো ব্যবহার করে চলেছে?

সামরিক অস্ত্র বা সরঞ্জাম যখন কেনা হয় তখন দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে কেনা হয়। অনেকগুলো ক্রাইটেরিয়া মেনে কেনা হয়। প্রয়োজনীয়তা, দক্ষতা, কোয়ালিফিকেশনস, পাইলটদের ট্রেনিংয়ের ধরন, যারা মেইনটেইন করবেন তাদের অভিজ্ঞতার ধরন, বাজেট, সুপার পাওয়ারদের দৃষ্টিভঙ্গি—সবগুলোর প্রভাব এখানে থাকে। আমি যতদূর জানি এ বিমান কেনার পরিকল্পনা হয় ২০১১ সালে এবং ডেলিভারি দেয়া হয় ২০১৩ সালে। এ বিমান যখন ক্রয় করা হয়েছিল, তখন এটি ছিল চীনের সবচেয়ে ভালো প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। পরে বাংলাদেশের চাহিদা অনুপাতে গ্লাস, জিপিএস ও নিরাপত্তাবিষয়ক যন্ত্রপাতিসহ কিছু জিনিস সংযোজন করা হয়েছে। এজন্যই এর নাম দেয়া হয়েছে এফ-৭ বিজি। এখন প্রশ্ন করতে পারেন চীনের বিমান কেন? ইউরোপীয় নয় কেন? এটা করাই যায়। এখানে অর্থ বড় ইস্যু। এছাড়া আপনি প্রথমে চীনের যন্ত্রপাতি, এরপর রাশিয়ার যন্ত্রপাতি, তারপর ইউরোপীয় যন্ত্রপাতি কিনলেন, সেক্ষেত্রে টেকনিক্যাল টিমকে গড়ে তুলতে হবে। সুতরাং রিসার্চ করে আপনাকে একটি ব্লকের দিকে থাকতে হয়, সেটাকে ধীরে ধীরে উন্নত করতে হয়। তবে এটি পুরনো বিমান নয়। বিমান সাধারণত সেই রকম পুরনো হয় না। বিমানের ইঞ্জিনসহ ভেতরের যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করলেই নতুন হয়ে যায়। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, আমরা কেন এর চেয়ে ভালো বিমান কিনলাম না।

আধুনিক অনেক বিমানের তুলনায় বিধ্বস্ত বিমানটির সুযোগ-সুবিধা অনেক কম ছিল। বর্তমানে যুদ্ধবিমান কারিগরিভাবে অনেক উন্নত হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে আমাদের নতুন কোনো ব্লক থেকে নতুন বিমান ক্রয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা?

প্রযুক্তি দ্রুতই পরিবর্তন হচ্ছে, উন্নত হচ্ছে। যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে এটি আরো বেশি হচ্ছে। নতুন নতুন এআই-ভিত্তিক যন্ত্রপাতি সংযোজন হচ্ছে এখন। আমাদের উচিত ছিল এ পরিবর্তনের ধারা বজায় রাখা কিংবা প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে থাকা। আমরা এটা পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। এককভাবে কাউকে দায়ী করা মুশকিল। কভিড এসেছিল, মন্দা এসেছে, তারপর ডলারের একটা সংকট ছিল—সবকিছু মিলিয়ে আমাদের যাত্রাটা ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু দেশের অক্ষুণ্নতা রক্ষায় বা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমাদের কার্পণ্য করলে চলবে না। এক্ষেত্রে ভালো জিনিস ক্রয়েই অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

ভবিষ্যতে যুদ্ধবিমান ক্রয়ের ক্ষেত্রে আমরা কীভাবে টেকসই প্রকিউরমেন্ট ও মেইনটেন্যান্স পলিসিগুলো মানতে পারি?

সেনাবাহিনীর বিমান প্রকিউরমেন্ট ও টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনের সঙ্গে আমি নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলাম। সেনাবাহিনীর প্রকিউরমেন্টের প্রত্যেকটা সেগমেন্ট কিন্তু আলাদা এবং খুব নিখুঁতভাবে করা হয়। একজন যুদ্ধবিমান নির্বাচন করেন, একজন দেখতে যান, একজন কেনেন, একজন টাকা পরিশোধ করেন ও একজন যাচাই করেন। অর্থাৎ একটি যুদ্ধবিমান ক্রয়ের সঙ্গে অনেক সংস্থা জড়িত। গুণগত মানের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া হয় না। বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর ক্ষেত্রে ক্রয় প্রক্রিয়া ভিন্ন। তারাও একটি রিসার্চের মাধ্যমে এটি ক্রয় করেন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানের দিকেই নজর দেব। কারণ তাদের যুদ্ধবিমানগুলো খুবই টেকসই ও অত্যাধুনিক।

বিমান দুর্ঘটনার পর একটা প্রশ্ন আসছে, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কেন বিমান উড্ডয়ন? আবার দেখা যাচ্ছে, আমাদের এয়ারবেজ যখন তেজগাঁও থেকে কুর্মিটোলায় স্থানান্তর করা হয়, তারপর সেখানে ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

এটি একটি জটিল বিষয়। দেশে জায়গার স্বল্পতা আছে। আপনি চাইলেই কিংবা টাকা থাকলেই এয়ার বেজ তৈরি করতে পারছেন না। সীমিত সামর্থ্যেই সীমিত সম্পদের সুষম বণ্টন করতে হবে। কক্সবাজারে রানওয়ে বড় আছে, সেখানে কেন এয়ারবেজ করা হলো না। কারণ কক্সবাজারে একপাশে সমুদ্র এবং অন্যপাশে আন্তর্জাতিক সীমানা। যশোরে রানওয়ে আছে। ওপরে উঠলেই ৩০-৪০ কিলোমিটারের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমানা। চাইলেই সম্পদগুলো ব্যবহার করা যাচ্ছে না। যেকোনো দেশ তার সমরাস্ত্র, যুদ্ধবিমান বা সরঞ্জাম কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রাখা হয় যেন যখনই প্রয়োজন হবে তা দ্রুত কার্যকর করা যায়। প্রশিক্ষণের জন্য হঠাৎ করে কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া হলো, কিন্তু পাইলট ঢাকায়, তাহলে হবে না। পাইলটকে ৩-৪ মিনিটের মধ্যে যুদ্ধবিমান সচল করে শত্রুর বিমানকে ধাওয়া করতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি, এসব জিনিস যেখানে আছে সেখানেই থাকা উচিত। প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে যদি স্থান পুনর্নির্ধারণ করা যায় তাহলে সরকার সেটি করতে পারে। তবে আমাদের এর সঙ্গে ব্যালান্স করে চলতে হবে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তথ্যে দেখা যাচ্ছে, পরিত্যক্ত ছয়টি এয়ারবেজ পড়ে আছে। সেগুলোকে পুনরায় চালু করার সুযোগ আছে কিনা?

চালু করা গেলে অবশ্যই ভালো হবে। যেমন আমি ব্যক্তিগতভাবে চাইব ঠাকুরগাঁওয়ে যে পরিত্যক্ত বিমানবন্দর আছে সেটিকে পুনরায় চালু করা হোক। আমাদের এত সম্পদ আছে, যেটাকে কার্যকর করলে সেটি আমাদের লভ্যাংশ দেবে। সব জায়গায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে—সেটা দরকার নেই। হেলিকপ্টার বা অন্যান্য বিমান সেখানে শিফট করে নিয়ে যেতে পারে। সম্পদ ফেলে রাখার সুযোগ নেই। তবে এখানে বাজেট একটা বড় ইস্যু। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক বিমানবন্দরে রূপান্তরের জন্য বাজেট পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু টাকার অভাবে সেটির কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু টাকার অভাবই বড় ইস্যু না, এখানে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিষয় জড়িত। সবকিছু মিলিয়ে আমরা একটা ডেড জোনে পড়ে আছি। সঠিক নেতৃত্ব পেলে এবং আইন ও নীতি মেনে চললে দেশ সামনে এগিয়ে যাবে।

বাণিজ্যিক ও সামরিক বিমানগুলো একই রানওয়েতে চলার কারণে আমরা কি বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ছি?

না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী একই রানওয়ে সামরিক ও বেসামরিক বিমান ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। যেহেতু আমাদের অন্য কোনো সুযোগ নেই তাই সেটা আমরা করছি। তবে আমরা এটাকে কীভাবে মিনিমাইজ করছি সেটা জানলেই হবে। আমাদের যে টাওয়ার আছে যারা এটা নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের দুর্দান্ত দক্ষতা আছে। তারা সামরিক যুদ্ধবিমান ও সিভিল এয়ারলাইনসগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ম্যানেজ করতে পারে। সবসময় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর বিমানগুলো অপারেশনাল মিশনে থাকে, সেগুলো অগ্রাধিকার পায়। আমাদের কন্ট্রোলাররা অত্যন্ত চমৎকারভাবে কাজটি করছেন। তাদের রাডার ও সরঞ্জামগুলো পুরনো। তারা নিজস্ব মেধা কাজে লাগিয়ে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। উন্নয়নের কথা যখন বলি তখন রানওয়ে বানানোর চেয়ে সরঞ্জামগুলো আধুনিকায়ন করা দরকার। জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধি করা দরকার। তাহলেই আমরা ভালো সেবা পাব।

দুর্নীতির কথা আসছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মিগ-২৯ কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধেও রাডার ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। সে সম্পর্কে জানতে চাই।

প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ে পৃথিবীর সব জায়গায় দুর্নীতি হয়। আমাদের দেশ এর বাইরে না। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই দুর্নীতি করে। একটি যুদ্ধবিমানের জন্য আপনি ৫০০ কোটি টাকা দিচ্ছেন। এটা বড় টাকার খেলা। কারো সঙ্গে চুক্তিতে গেলে শুধু বিমানই কেনা হচ্ছে না, পাশাপাশি আনুষঙ্গিক অনেক কিছুই কেনা লাগছে। ১০ বছর ধরেই এর ফল পাচ্ছেন। পশ্চিমা বিশ্বে এ দুর্নীতি আরো বেশি হয়। আমাদের দেশেও এ ঘটনার বাইরে কেউ নেই। আমরা অনেক ঘটনা শুনেছি। বিভিন্ন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এর আগে বিমান বাহিনীর প্রধান দুর্নীতির মাধ্যমে অনেক টাকা বাইরে নিয়ে গেছেন। সেই টাকা যদি যুদ্ধবিমানের ব্যবস্থাপনায়, প্রশিক্ষণে ও পাইলটের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কাজে ব্যয় করত তাহলে এ দুর্ঘটনা ঘটত না।

বিমান দুর্ঘটনার পর আরো কিছু ঘটনার উৎপত্তি হয়েছে। লাশ শনাক্ত ও লাশের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে মব তৈরি হচ্ছে। গত মঙ্গলবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সচিবালয়ে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঢুকে পড়েছিল। এগুলো কেন হচ্ছে?

সার্বিক অব্যবস্থাপনা ও আইনের প্রয়োগ না থাকার সংস্কৃতির কারণে এগুলো বারবার হচ্ছে। যদি আইন প্রয়োগ না ঘটে, আইন না মানার সংস্কৃতি দীর্ঘদিন গড়ে ওঠে, তাহলে সবাই মনে করবে নিজে ঠিক এবং অন্যরা ভুল। এভাবেই মব সংস্কৃতি বা আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। আবেগ থেকেই এসব করছে। কারো আবেগ নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন না। কিন্তু সবকিছু যদি আইনের আওতায় আনা হতো তাহলে আইনের প্রতি বিশ্বাস জন্মাত এবং মানুষ এসব ক্ষেত্রে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করত।

আপনি বলছিলেন পাইলটদের আত্মহত্যার প্রবণতা থেকেও দুর্ঘটনা ঘটে। আরো নানা কারণেও ঘটে। ভবিষ্যতে এসব ঝুঁকি কীভাবে কমিয়ে আনা যায়?

এক পাইলটের মানসিক অবসাদ এলে সে আত্মহত্যামুখী হলে অবশ্যই তার সহকর্মীকে এগিয়ে আসতে হবে। তাকে সঙ্গ দিতে হবে। কিন্তু আজকাল আমরা সোশ্যাল মিডিয়াকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি! প্লেন থেকে নেমেই ফেসবুক টুইটার চেক করছি কে কয়টা মেসেজ দিল! আমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কমে যাচ্ছে। একটা সময় আমরা আড্ডা দিতাম, ঘুরতে যেতাম, সুইমিং করতাম। এখন এসব কমে যাচ্ছে ফলে সম্পর্কগুলো দুর্বল হচ্ছে! মানসিক স্বাস্থ্য দুর্বল হচ্ছে। তার অবসাদ কারোর কাছে শেয়ার করতে পারছে না। এগুলোর ফলে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে কেউ কেউ।

বর্তমানে এভিয়েশনের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা অনেক আগে থেকে বিদ্যমান কিন্তু এখনো কোনো সমাধান হয়নি।

আমাদের সুযোগ-সুবিধা ও প্রযুক্তিতে ঘাটতি আছে। আমাদের বিমানবন্দর আছে কিন্তু আধুনিক সুবিধাগুলো এখানে নেই। আমাদের সম্পদ আছে, সুবিধা নেই। এটাকে মেনেজ করতে পারলেই হবে।

আপনি উড্ডয়ন জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আপনার দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সরকারকে কী পরামর্শ দেবেন?

সরকারের কাজ রাস্তা ও ব্রিজ বানানো না। সরকার এমন একটি পরিবেশ তৈরি করবে যেখানে প্রত্যেকেই নিরাপদে কাজ করতে পারবে। একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কোনো বিভাজন হবে না। নেতা হতে হলে সবার নেতা হতে হবে। আপনার ভুল থাকবে, দুর্নীতি হবে কিন্তু সরকারকে-জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে। তিনি জনগণের সরকার হবেন, জনগণের আওতাধীন থাকবেন।

সূত্র, বণিক বার্তা