গত ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত রেডিও ও টেলিভিশন ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করেছেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, আগামী রমজান মাসের পূর্বেই দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার এই ঘোষণা একদিকে যেমন বিপুলভাবে অভিনন্দিত হয় অন্যদিকে তেমনি নির্বাচন হবে কিনা, অথবা বিলম্বিত হবে কিনা, সেই নিয়ে যে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছিলো সেটি দূর হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহম্মেদ ড. ইউনূসের এই ঘোষনাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
নির্বাচনের সময় ঘোষণার সাথে সাথে ড. ইউনূস দেশের সমস্ত ভোটারকে উৎসবের সাথে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি একটি হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন। ঐ হুঁশিয়ারিতে তিনি বলেন, আপনারা প্রত্যেকেই অবগত আছেন, একটা গোষ্ঠী নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। তারা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে দেশের বাইরে বসে এবং ভেতরে থেকে নানা অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। আমাদেরকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন নির্বাচনকে সংঘাতময় করে তোলার কোনো রকমের সুযোগ না পায়। মাথায় রাখবেন, পরাজিত শক্তি নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে। কিন্তু একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সফলভাবে আয়োজন করা গেলে অপশক্তির পরাজয় চূড়ান্ত হবে।
এই দেশি-বিদেশি চক্রান্ত সম্পর্কে এবারই তিনি সাবধান বাণী উচ্চারণ করলেন না, এর আগেও তিনি একাধিকবার এই ধরনের সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, এক বছর যেতে না যেতেই পরাজিত শক্তির নানা ষড়যন্ত্রের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, মতপার্থক্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যকে আরও দৃশ্যমান করা দরকার। তা না হলে তারা এটাকে সুযোগ মনে করছে। ১৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ড. ইউনূস এ কথা বলেন বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে। অতিথি ভবন যমুনায় এ বৈঠক হয়। সেখানে আলোচনার বিষয়বস্তু সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তুলে ধরেছে প্রেস উইং।Fashion trends
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরে আমাদের আয়োজন ছিল সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে নিয়ে অতীতকে স্মরণ করা, সে জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলাম। এতে করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের মধ্যে ঐক্যটা দৃশ্যমান হতো। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই পরাজিত শক্তির নানা ষড়যন্ত্রের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।’
বৈঠকে অংশগ্রহণকারী সব দল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও গণঐক্য অটুট রাখার বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছে বলে প্রেস উইংয়ের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, তারা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে প্রধান উপদেষ্টাকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
শুধুমাত্র প্রধান উপদেষ্টা নন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এমন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন করেছেন। দেশ নিয়ে একটা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলছে। একটা অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চলছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দেয়া হয়েছে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, একটা ধ্বংসের পথ পার করেছি। ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজনীতিকে মেরামত করে সামনে এগোতে হবে। বিএনপিকেই সেই দায়িত্ব নিতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। বাংলাদেশ কখনো মাথা নত করেনি, লড়াই করে গেছে, সংগ্রাম করে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা লড়াই করেছি, রক্ত দিয়েছি। জিয়াউর রহমান আমাদেরকে একটি নতুন দেশ দিয়ে ছিলেন। একদলীয় শাসন থেকে গণতান্ত্রিক দেশ করেছিলেন। অর্থনীতিতে নতুন যাত্রা করেছিল দেশ। গণতন্ত্রের যতগুলো কাঠামো আছে তার সবকিছু জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া করেছেন।Bangladeshi cuisine
॥দুই॥
প্রধান উপদেষ্টা এবং বিএনপি মহাসচিবের এসব সাবধান বাণীকে পলিটিক্যাল রেটোরিক হিসাবে মনে করার কোনো অবকাশ নেই। কারণ, এ সম্পর্কে বিবিসি যে রিপোর্ট করেছে এবং ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে সেসব খবর পর্যালোচনা করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, পতিত স্বৈরাচার ভারতে বসে ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। এছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ৫ আগস্ট নির্বাচনের সময় ঘোষণা করার পর থেকেই মুহূর্তের মধ্যে ভারতীয় গণমাধ্যমে উল্টো সুরে গান গাওয়া শুরু হয়েছে। এসব নিয়ে একটু পরে আলোচনা করছি। তার আগে বিবিসির রিপোর্টের ওপর একবার চোখ বুলানো যাক।
থ্রিলার কাহিনীর মতো বিবিসি রিপোর্ট করছে এভাবে, ‘কলকাতা লাগোয়া উপনগরীটাতে শয়ে শয়ে বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স, রাতদিন লাখো মানুষের ভিড় সেখানে। ব্যস্ত এই এলাকায় একটি বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সে এমন কয়েকজন যাতায়াত করছেন, যাদের কয়েক মাস আগেও সেখানে দেখা যেত না। ঐ বাণিজ্যিক পরিসরে যারা যাতায়াত করেন, এমন বেশির ভাগই চেনেন না এই নবাগত ব্যক্তিদের। চেনার কথাও নয়। তবে তাদের অনেকেই মাত্র এক বছর আগেও বাংলাদেশের সব থেকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তারা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ ও মধ্যম স্তরের নেতা। তারা যে বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সটিতে যাতায়াত করছেন কয়েক মাস ধরে, সেখানেই দলীয় দপ্তর খুলেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।’ বিবিসি বলেছে, এই পার্টি অফিসটি নতুন।
রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘বাণিজ্যিক পরিসরটির পেছনের দিকের ভবনটির আট তলায় লিফট দিয়ে উঠে বাঁ দিকে গেলেই সারি দিয়ে বাণিজ্যিক সংস্থার দপ্তর। করিডরের দুই দিকে হালকা বাদামি রঙের একের পর এক দরজা। তার মধ্যেই একটিতে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিস।’
শুধু বাইরে কেনো, ৫০০ বা ৬০০ স্কয়ার ফুটের ঘরটিতে উঁকি মারলেও কেউ বুঝতে পারবেন না যে, এই ঘরের সঙ্গে কোনোভাবে আওয়ামী লীগ জড়িত আছে। কোনো সাইনবোর্ড, শেখ হাসিনা অথবা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ছবি কোথাও নেই ঘরটির বাইরে বা ভেতরে।
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বা নেত্রীর কোনো ছবি, সাইনবোর্ড কোনো কিছুই আমরা রাখিনি খুবই সচেতনভাবে। আমরা চাইনি যে এই ঘরটার পরিচিতি প্রকাশ করতে। এমনকি একটা দলীয় দপ্তরে যেসব ফাইল ইত্যাদি থাকে, সেসবও এখানে রাখা হয় না। নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ, বৈঠক ইত্যাদির জন্য একটা ঘর দরকার ছিল, এটা পাওয়া গেছে। ৭০ জন সাবেক সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক মেয়রসহ শীর্ষ নেতৃত্বের প্রায় ২০০ জন কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলে থাকছেন।’
॥তিন॥
আমি গত ১ মাস ধরে ব্যক্তিগতভাবে একটি গবেষণা চালাচ্ছি। এই গবেষণায় আমার কাছে অন্তত ৬৪টি নাম এসেছে যারা আওয়ামী লীগের তৃণমূল কর্মী নন। তৃণমূল তো পরের কথা, মধ্যম পর্যায়ের নেতাও নন। আওয়ামী লীগের অন্তত ৬৪ জন শীর্ষ নেতা দেশ থেকে বেরিয়ে গেছেন। এদের প্রায় ৯০ শতাংশই ভারতে। এই ৯০ শতাংশের মধ্যে ৯৫ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গে আস্তানা গেড়েছেন। সামান্য কয়েকজন দিল্লিতে আছেন। আর কয়েকজন শীর্ষ নেতা ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া ও সুইডেনে অবস্থান করছেন।
এসব দেশে যারা আছেন তাদের কয়েকজনের নাম আমি এখানে উল্লেখ করছি। এরা হলেন, কলকাতার রাজারহাট নিউটাউন এলাকায় ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী নাসিম আছেন টাটা হাউজিং এভিনিউতে। ওবায়দুল কাদেরের খরচ বহন করছেন সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী।
পশ্চিমবঙ্গে আরো আছেন সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খানের জামাতা তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনির। আরো আছেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। কলকাতায় আরো আছেন, জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং বাহাউদ্দিন নাছিম। কার নাম করবো আর কার নাম করবো না। শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল, তার ছেলে তন্ময়, নসরুল হামিদ বিপু, অসীম কুমার উকিল, তদ্বীয় স্ত্রী অপু উকিল, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকিও কলকাতাতেই আছেন। মাহবুবুল আলম হানিফ আছেন দিল্লিতে।
॥চার॥
গত সপ্তাহে শেখ হাসিনা দিল্লিতে একটি মিটিং ডেকেছিলেন। অনেকটা ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ের মতো। অবাক ব্যাপার হলো শেখ হাসিনা কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকলেও আলোচ্য মিনি ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং মোদি সরকারের নলেজেই হয়েছে। কলকাতায় অফিস খোলা এবং দিল্লিতে মিনি ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ের নেপথ্য কারন জানা গেছে।
মূলধারার বলে বহুল পরিচিত একটি বাংলা দৈনিকে বলা হয়েছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারকে ফেলে দিতে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের ‘ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা-২’ সক্রিয় করা হচ্ছে। যার প্রধান টার্গেট অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর। ৩ মাস জুড়ে এই প্ল্যানের কাজ চলবে। এর আগে সরকারকে অচল করে দিতে দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে বিশেষ কিছু কার্যক্রম শুরু হবে। এসব গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন কার্যত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম, মাহবুবউল আলম হানিফ, সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ বেশ কয়েকজন। অফিশিয়ালি বসে কাজের সমন্বয় করতে ইতোমধ্যে কলকাতা ও দিল্লিতে আওয়ামী লীগের পৃথক গোপন অফিসও খোলা হয়েছে। সেখানে তারা ৫ আগস্ট থেকে কাজ শুরু করেছেন। এ চক্রের কাজে সহায়তা দিতে বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নেপথ্যে থেকে সক্রিয়ভাবে রসদ জোগাচ্ছেন।
এটিকে তারা নাম দিয়েছে ‘ হিট প্ল্যান-২’। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট টার্গেট হিট করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করা। এসম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ পরবর্তী কোনো এক কলামে দেওয়ার ইচ্ছা রাখি।