আমাদের গণতন্ত্রে উত্তরণের মূল ভিত্তি হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এই ভিত্তিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো উঠে এসেছে, তা কেবল ইসির একার নয়, বরং পুরো জাতির সামনে এক গভীর সংকটের চিত্র ফুটে উঠেছে। যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসির কর্মকর্তারা নিজেরাই স্বীকার করছেন, তাদের সামনে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। বিগত নির্বাচনগুলোয় ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে যে সংশয় তৈরি হয়েছে, তা দূর করা সহজ কাজ নয়। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের পরিণতি বর্তমান কমিশন ও প্রশাসনের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা হিসাবে কাজ করছে। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে জনগণের অসন্তোষ যে কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, তা এ ঘটনাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে অশুভ শক্তি ফায়দা নিতে পারে, যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও দুর্বল করবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করাও ইসির জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। বিগত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে একটি বড় বাধা। যদি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করে, তাহলে শুধু ইসি এককভাবে একটি অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে না। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাই ইসিকে আরও সক্রিয় ও কৌশলী হতে হবে। তারা বর্তমানে যেসব প্রস্তুতিমূলক কাজ করছে, যেমন: আরপিও সংশোধন, সীমানা নির্ধারণ বা ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণ-এগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেবল এসব কাজে মনোনিবেশ করলেই হবে না, ইসিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আস্থা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। সব রাজনৈতিক পক্ষকে আস্থায় নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করাই এখন তাদের প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো এবং বিশেষ করে নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপব্যবহার রোধের মতো নতুন চ্যালেঞ্জগুলোও ইসিকে গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ; কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়নও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সার্বিকভাবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার দায় শুধু নির্বাচন কমিশনের একার নয়। এটি সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং সর্বোপরি জনগণের সম্মিলিত দায়িত্ব। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতার মাধ্যমে সংকট নিরসনের পথ খুঁজে বের করতে হবে। ইসিকে তার সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। জনগণকেও সচেতন হয়ে এ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হবে। তবেই আমরা একটি সত্যিকারের অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব, যা আমাদের গণতন্ত্রকে নতুন জীবন দেবে।