ভোটের হাওয়া বইছে দেশের সর্বত্রই। কতিপয় রাজনৈতিক দল প্রার্থী নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। জাতিসংঘ ও উন্নয়ন সহযোগীরা সকলের অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার আহ্বান জানিয়েছে। সরকার ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছে। এটা হবে দেশের ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন বলেছে, সরকারের নির্দেশনা পেলে সে মোতাবেক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। নির্বাচনের রোড ম্যাপ বা তারিখ নির্ধারণ নিয়ে যে বিতর্ক চলছিল লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের মাধ্যমে তার ফয়সালা হয়েছে। স্মরণীয় যে, ভোটপাগল জাতি দীর্ঘদিন তথা গত পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের শাসনামলে ইচ্ছা মতো ভোট দিতে পারেনি। ফ্যাসিস্ট সরকার একতরফা ও তামাশার নির্বাচন করেছে। তাতে নিজেরা এবং কিছু উচ্ছিষ্ট ভোগী নিয়ে আমি আর ডামির নির্বাচন হয়েছে। ফলে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। তাই ভোটের দিন সব ভোট কেন্দ্র ফাঁকা থেকেছে। তবুও মানুষ রূপী কিছু অমানুষের কর্মকা-ে ভোটের বাক্স পূর্ণ হয়েছে। সেটা নিয়েই ফ্যাসিস্টরা বিজয়ের ডুগডুগি বাজিয়েছে। বাংলাদেশ হাইব্রিড গণতন্ত্রের দেশ বলে চিহ্নিত হয়েছে। সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি-ডেম ইন্সটিটিউট কর্তৃক গত ৭ মার্চ, ২০২৪ প্রকাশিত ‘ডেমোক্রেসি উইনিং অ্যান্ড লুজিং অ্যাট দ্য ব্যালট’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, উদার গণতান্ত্রিক সূচকে (লিবারেল ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে) ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম, স্কোর শূন্য দশমিক ১০, যা চরম লজ্জাজনক। তাই ভোট দিতে না পারা এবং সীমাহীন লুটপাটের কারণে মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪। এদিন গণঅভ্যুত্থানে সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনাসহ তার সাঙ্গপাঙ্গদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। তবুও দলটির নেতারা কৃতকর্মের ভুল স্বীকার করেনি এবং জাতির কাছে ক্ষমা চায়নি! আগামী জাতীয় নির্বাচনে পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তার কার্যক্রম ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। সে কারণে আওয়ামী লীগ ঘেঁষা বামপন্থীদের অবস্থাও হবে তথৈবচ। জাপার অবস্থাও করুণ। ফ্যাসিস্টদের দালালিপনার কারণেই দেশের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি বলে খ্যাত দলটির এই অবস্থা হয়েছে। উপরন্তু দলটির নেতৃত্বে কোন্দল সৃষ্টি হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রধান দল হবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলাম। অতীতে জামায়াত ও বিএনপি আসন ভাগাভাগি করে কিংবা জোটগতভাবে নির্বাচন করেছে। কিন্তু আগামী নির্বাচনে তা হবে না। পৃথকভাবে নির্বাচন করবে এবং একে অপরকে প্রতিপক্ষ জ্ঞান করবে। জামায়াত দেশের ইসলামপন্থীদের সাথে জোট করে নির্বাচন করার চেষ্টা করছে। এতে সফল হলে দেশের ইসলামপন্থীরা একটা উল্লেখযোগ্য শক্তিতে পরিণত হবে। বিএনপি তার সমমনাদের নিয়ে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচন করার এবং বিজয়ী হলে তাদের নিয়ে সরকার গঠন করার কথা বলেছে। দলটি নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হবে বলে খুবই আশাবাদী। সাধারণ মানুষেরও ধারণা ও অভিপ্রায় তাই। সরকারি দল বলে খ্যাত জাতীয় নাগরিক পার্টি তথা এনসিপিকে নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। সরকারি দল হিসাবে অতীতের ন্যায় জোর করে কেন্দ্র দখল করে ইচ্ছা মতো সিল মেরে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সুযোগ নেই এবার।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে নির্বাচনে কোনো জবরদস্তি হবে বলে মনে হয় না। নির্বাচন খুবই নিরপেক্ষ হবে। সেটা হলে এনসিপি নির্বাচনে তেমন সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। স্মরণীয়, নির্বাচন কমিশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মোট ভোটারের সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লাখ ৩২ হাজার ২৭৪ জন। এ তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে ৬৩ লাখ ১৭ হাজার ৬০০ জন এবং মারা যাওয়ায় ২৩ লাখ ২৭ হাজার ১১৭ জনের নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান-আইন মতে, বাংলাদেশে ভোটার হওয়ার সর্বনি¤œ বয়স ১৮। বলা আবশ্যক, শুধুমাত্র জাতীয় নির্বাচন তথা জাতীয় সংসদের নির্বাচন করলেই চলবে না, সেই সাথে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনও করতে হবে। কারণ, এসবের সর্বত্রই প্রশাসক দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। তাতে গণতন্ত্রের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি উন্নতিরও বেঘাত ঘটছে। তাই দেশের সর্বত্রই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী নির্বাচনের ন্যায় সংস্কারও খুবই জরুরি। কারণ, দলীয় সরকার সাধারণত সংস্কারবিমুখ। যার জ্বলন্ত প্রমাণ-সংবিধান মতে বিচার বিভাগসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পূর্ণ স্বাধীন। দেশের সংবিধান রচনাকালেই তা করা হয়েছে গণতান্ত্রিক বিশ্বের রীতি নীতি অনুযায়ী। কিন্তু সেটা দেশে বাস্তবায়িত হয়নি স্বাধীনতাত্তোর থেকেই। সর্বত্রই অনুগতদের তথা দলদাসদের বসিয়ে ইচ্ছা মতো কাজ করিয়ে নিয়েছে প্রায় সব সরকারই। বিচারপতি খায়রুল হক বিচার বিভাগকে যেভাবে পতিত স্বৈরাচারের দাসে পরিণত করেন তার নজির বিশ্ব ইতিহাসে কমই আছে। বিচার বিভাগ আস্থাহীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত, এখন বিচার বিভাগ স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হওয়ার পথে। অথচ, এখন উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে প্রথম। ফলে যোগ্য ব্যক্তিরা বিচারপতি হওয়ার সুযোগ পাবেন। বিচার নিরপেক্ষ ও ন্যায্য হবে। বিচার বিভাগের নিজস্ব সচিবালয়ও প্রতিষ্ঠা করার কাজ শুরু হয়েছে। সেটা সম্পন্ন হলে বিচার বিভাগের যাবতীয় কাজ সেখান থেকেই হবে। সরকারের কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। দেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হবে। বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধার হবে। সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানেও একই অবস্থা হবে। সুতরাং রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার এগিয়ে নিতে হবে। এটা নির্দিষ্ট সময়রেখা মেনে হচ্ছে না। সংস্কার একটি চলমান প্রতিক্রিয়া। নির্বাচিত সরকারও এটা চালিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।
লেখক:সাংবাদিক ও কলামিস্ট।