গত বছর স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিলো দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা ফেনী। ফেনী জেলার মানুষের কাছে গতবারের বন্যা একদিকে যেমন ছিলো আকস্মিক অন্যদিকে অকল্পনীয়। শুধু ফেনী নয়, এর আশপাশের জেলাগুলোতেও বন্যা আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছিলো। বহু জায়গায় বন্যার পানি ঘরের চাল ছুঁয়েছে কিংবা উপচে গেছে। গত বছরের বন্যা ব্যতিক্রম হলেও প্রায় এই ভাবেই সময়ে-অসময়ে মুহুরী ভাসিয়ে দেয়, তলিয়ে দেয় ফেনীর মানুষকে। ফেলে চরম ভোগান্তিতে। আবার মহলবিশেষকে লাভবানও করে। ছোট-বড় প্রতিটি বন্যায় প্রচুর পলি জন্মে। নদীর এ পলি-বালি তাদের জন্য আশীর্বাদ। ভোগে হাজার-লাখ মানুষ, আর নদী থেকে অবৈধভাবে দিনে-রাতে সমানে বালি তুলে লাখপতি-কোটিপতি হয় কিছু মানুষ। মাঝেমাধ্যে জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা বা কড়াকড়িতে তাদের তেমন সমস্যা হয় না। তাদের এটি নিয়মিত বনেদি ব্যবসার মতো। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে এ বাণিজ্যের হাতবদল হয় মাত্র। এর বিস্তার ফেনী থেকে চট্টগ্রামের মিরসরাই পর্যন্ত। ড্রেজার বসিয়ে ওপেন সিক্রেট চলে আসছে এ কারবার। ক’দিন আগে আবারও মুহুরী নদীতে বান ডাকায় কষ্টে পড়েছে নদীপাড়ের মানুষ। ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে ফেনীর ফুলগাজীতে মুহুরী নদীর উত্তর বরইয়া নামক স্থানে বাঁধ ভেঙে যায়। এতে মুহূর্তেই পানি ঢুকে যায় উত্তর বরইয়া গ্রামের বিভিন্ন বাড়িঘরে। নিচু এলাকা প্লাবিত হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়ে গ্রামের বাসিন্দারা। রাতে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়ে বাসিন্দারা। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে যায়। দক্ষিণবরইয়া, বিজয়পুর, বসন্তপুর, ফতেহপুর, বশিখপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর নিম্নঞ্চল প্লাবিত হয়। ফুলগাজী বাজারে পানি ওঠায় সেখানে দোকানপাটের মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরশুরাম উপজেলায়ও নদীর পাড় দিয়ে পানি ঢুকে লোকালয়ে প্লাবিত হয়। তাদের এ কষ্টের বিপরীতে আয়-রোজগার জমে বালির কারবারিদের। নিষ্ঠুর এক তামাশা। বালুগুলো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় শুভপুর, মুহুরী ব্রিজ, লেমুয়াসহ বিভিন্ন স্পটে নিয়ে যাওয়া হয় প্রকাশ্যে। সেখান থেকে বিভিন্ন সেলস সেন্টারে রেখে তা বিক্রি করা হয়। যেন এক মহোৎসব। প্রতিদিন ওইসব এলাকার বিভিন্ন স্পট থেকে লাখ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হয়। বলতে গেলে ইজারাও লাগে না। সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা জানেও না তারা কাকে শ্রম দিচ্ছে। তাদের বালু তুলতে নিয়ে আসা হয়। তারা কাজ করে নগদে টাকা পায়। নেপথ্যের কারবারিদের চেনে না। চেনার দরকারও পড়ে না। না চিনলে সমস্যাও হয় না। কিছুদিন আগে, ফেনী নদীর কয়েকটি স্পট থেকে কিছু ড্রেজার মেশিন জব্দ করা হয়। স্থানীয় সাংবাদিকসহ আশপাশের মানুষ আশাবাদী হয়, এবার বোধহয় সত্যি সত্যি কিছু একটা হতে যাচ্ছে। বাস্তবে দেখা গেল, সাংবাদিকদের কষ্টা প-। আর স্থানীয় আশাবাদীদের আশায় গুড়েবালি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে মূহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদী থেকে অবৈধভাবে বালু লুটপাট একটা উৎসবের আমেজ পায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বাপের তালুক পাওয়ার মতো চুটিয়ে এ বাণিজ্য চালায়। জনপ্রতিনিধিদের ঘনিষ্ট স্থানীয় নেতাকর্মী ও স্বজনদের এ ব্যাপারে কাউকে কেয়ার করতে হয়নি। ডেমকেয়ারে চলেছে সব। ৫ আগস্টের পট তাদের একটা বিরাট অংশ চম্পট দিয়েছে। কিন্তু, বালু বাণিজ্য থামেনি। হাত বদল হয়েছে ম্যাজিকের মতো। বালুর এ কারবারে গত মাস কয়েকেই নতুনরা ফুলেফেঁপে এক একটা কলা গাছ-বট গাছ বনে গেছে। এ আলামতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কয়েকটি কথা খুব মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, বন্যায় আমাদের কষ্ট-ক্ষতি হয়। আবার আমাদের লাভও আছে। আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড রিচার্জ হয়। তিনি বন্যায় যে পলি আসে তা দিয়ে জমির ফার্টিলিটি বৃদ্ধির কথা মিন করেছিলেন। আদতে ওই বালু দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পোক্ত হয় দলবাজ-ফড়িয়াদের। বালুর কারবার তাদের অর্থনৈতিক প্রোফাইল বাড়িয়ে দেয়। কোন নিষ্ঠুর বাস্তবতায় আছি আমরা। মহুরী নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে একদিকে কিছু মানুষের পোয়াবারো। আরেকদিকে, পরিবেশ ও জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কিছু ব্যক্তি ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে, পরিবেশকে আক্রান্ত করছে। তাদের অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর তীরবর্তী এলাকা ভেঙ্গে যাচ্ছে, যার ফলে ঘরবাড়ি, ফসলি জমি এবং রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও বিক্রির কারণে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। প্রশাসন অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান চালায়। বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কিছু ব্যবস্থাও নেয়। একটা সময় এর আর ফলো আপ থাকে না। অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়লেও এর বিহিত শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ ভাঙন ও অন্যান্য সমস্যার কারণে বসতবাড়ি, জমি ও অন্যান্য সম্পদ হারাচ্ছে, যার জন্য তাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রয়োজন। মহুরী নদীর অবৈধ বালু ব্যবসা বন্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত এবং যারা এই ব্যবসার সাথে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। এর সমান্তরালে অভিজ্ঞতার কারণে বালুখেকো ও তাদের গডফাদাররা জানে কয়েকটা দিন হম্বিতম্বিই সার। তারাও জানে, ড্রেজার বসিয়ে ইচ্ছেমতো নদী থেকে বালু উত্তোলন করাটা সম্পূর্ণ অনৈতিক। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের জেরে নদীর যে ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তা ভাবার সময় নেই তাদের। অথচ পরিকল্পণা নিলে এ নদীটিকে অভিশাপ থেকে আশীর্বাদে পরিণত করা যায়। মুহুরী নদী বাংলাদেশের একটি সীমান্ত নদী, যার প্রস্থ সাধারণত ১৫০-২০০ মিটার এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিলোমিটার। উৎপত্তি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিলোনিয়া এলাকায়। পরিণতি বাংলাদেশের ফেনী জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরে।Real estate কৃষি, মৎস্য, সেচ এবং বালু সম্পদের জন্য এই নদী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা এবং ভুল নীতির কারণে নদীটি প্রায়শই বন্যা ও ভাঙনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গত চার দশকে মুহুরী নদীতে বিভিন্ন সময় অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। ফলে বিপুল সরকারি অর্থ অপচয় হয়েছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যায়নি। বর্ষার সময় অস্থায়ী বাঁধ টিকে থাকতে পারেনি, ফলে প্রতিবছর নতুন বাঁধ নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে। ২০ বছরে বারবার নির্মাণ কাজের কারণে প্রায় ২০০০ কোটি টাকার বেশি অপচয় হয়েছে। দুঃখজনকভাবে নির্মিত বাঁধগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। নিয়মিত সংস্কার হলে ভিন্ন চিত্র দাঁড়াতো নদীটিকে ঘিরে। তা না হওয়ায় বাঁধের কার্যকারিতা হারিয়েছে। ফলে নিচু অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদ বারবার বন্যার শিকার হয়েছে। গবেষণা ছাড়াই নেওয়া প্রকল্পগুলো পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করেছে, যা কৃষি ও মৎস্য খাতে ক্ষতির কারণ হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা লোপ পেয়েছে। ভারতীয় উজানের ঢলের স্রোত নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা না থাকায় ফসল ও জনজীবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে চাই কার্যকর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন প্রয়োজন। নদীর পাড় থেকে অন্তত ৫০০ গজ দূরে সুইচিং সিস্টেম ভেড়ি বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। তা করা হলে এটি পাহাড়ি ঢলের পানি ধারণ করবে এবং বন্যার ক্ষতি কমাবে। প্রতিবছর নিয়মিত নদী খনন করলে আরো প্রাপ্তি যোগ হবে। উজান থেকে আসা বালু উত্তোলন করে নির্মাণ শিল্পে ব্যবহার করা যেতে পারে। জমির মালিকদের অংশীদার করে বালু উত্তোলনের স্বচ্ছ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। রিজার্ভ পানি সেচের কাজে ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন বাড়ানো যাবে। কার্যকর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতি রোধ করবে। বাঁধ এলাকায় পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট এবং জলক্রীড়া কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব। এই প্রকল্পগুলো নিলে নিশ্চিত স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। পুরো বিষয়টিই নির্ভর করছে সদিচ্ছার ওপর। তখন অভিশাপ থেকে তা রূপ নেবে আশীর্বাদে। গত চার দশকের ত্রুটিপূর্ণ নীতি ও অপব্যবস্থাপনা থেকে শিক্ষা নিয়ে মুহুরী নদীর সঠিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। পরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, নিয়মিত খনন এবং পর্যটন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুহুরী নদীকে অভিশাপ নয়, বরং একটি আশীর্বাদে পরিণত করা সম্ভব। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতি, পরিবেশ এবং জনজীবনে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। তাই মুহুরী নদীকে ঘিরে একটি উন্নত প্রকল্প এখন সময়ের দাবি। তা নদীর পরিবেশগত স্বাস্থ্য রক্ষা, সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, এবং পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙা করবে। তার আগে দরকার মুহুরী নদীকে তার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং এর পরিবেশগত বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা। নদীটি বর্তমানে দূষণ, অবৈধ দখল, এবং বাঁধের কারণে হুমকির সম্মুখীন। এই নদীকে বাঁচাতে হলে, এর দূষণ রোধ করতে হবে, অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট [email protected]