মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যই ছিল অর্থনৈতিক সমতা, মানবিক মর্যাদা, ইনসাফ বা সামাজিক ন্যায় বিচার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। যে দলটি নিজেকে একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল হিসেবে দাবি করে, সে কী মুক্তিযোদ্ধাদের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছিল? সে কেন যুদ্ধকালীন জনতার ঐক্য ধরে রাখতে পারল না? কে মুক্তিযোদ্ধা, কে রাজাকার এটা নিয়ে রাজনীতি করার কী প্রয়োজন ছিল? যে তরুণ প্রজন্ম জাসদের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনতে চাইলো, তাদের জান কেন বিনাবিচারে কেড়ে নেয়া হলো? রাষ্ট্র কাঠামোর অন্যতম স্তম্ভ আইনের শাসন কেন একব্যক্তির কব্জায় দেয়া হলো? এরকম অনেক প্রশ্নের সমাপ্তি ঘটে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ এসে। দেশ ও জাতি মুক্তি পায় এক অন্ধকার যুগ থেকে। তখন দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে ৯০ শতাংশ মানুষ ঐ বিশেষ দলটি করত, এমনকি রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে বাধ্যতামূলকভাবে বাকশালে যোগ দিতে হয়। তারপরেও শেখ সাহেবের মৃত্যুর পর সারাদেশের কোথাও একটি মিছিল কেন বের হয়নি? টুঙ্গিপাড়াও তো কেউ নামল না।

তার মানে ঐ সময়ে এই দলটির কাজ-কাম কারোরই ভালো লাগে নাই অথবা ভয়ে রাজপথে নামে নাই। ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বর দৃশ্যপটে হাজির হলেন এক ক্ষণজন্মা পুরুষ, যার সাহসী ও বিপ্লবী ছোঁয়ায় অর্থনীতি বলেন, আইনের শাসন বলেন, গণতন্ত্র বলেন, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বলেন, সব কিছু নরমালাইজড হয়ে বিশে^ তলাবিহীন ঝুড়িখ্যাত দেশটি মর্যাদা পেল আধুনিক বাংলাদেশের। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠিত করেন। এই দলটি জন্মলগ্ন থেকেই জনবান্ধব অনেক কর্মসূচি নিয়ে একেবারে জনগণের কাছে পৌঁছে যায়। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, এটা প্রতিষ্ঠা করে বিএনপি এবং এখনও তা ধারণ করে। গণতন্ত্রের অপর নাম বিএনপি। ইতিহাস সাাক্ষী বিএনপি কখনও গণতন্ত্র হত্যা করে নাই বা কোনো স্বৈরাচারের সাথে গণতন্ত্রের ব্যাপারে আপোসও করে নাই। বিএনপি যতবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল জনগণের রাজনৈতিক অধিকার দাবিইয়ে রাখার চেষ্টা করে নাই। অথচ যে দলটি বাংলাদেশে রাজনীতি করার লাইসেন্স নিল বিএনপির হাত থেকে, সেই দলই তাকে শেষ করার ব্রত নিল। দেশনেত্রী, তিনবারের জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ এবং বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বিনা দোষে, ক্যাঙ্গারু কোর্টের রায়ে জেলে ভরলো, এমনকি বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে ব্যবস্থা করলো। ফ্যাসিস্ট হাসিনা ওয়ান-ইলেভেনের সময় ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিনের করা তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মামলা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেই বাতিল করলেন, আর দেশনেত্রীর সকল মামলা সচল করলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ষড়যন্ত্র করে দেশ থেকে বিতাড়িত করলেন এবং বিএনপির সাথে যাতে কোনো মাধ্যমেই যোগাযোগ না করতে পারেন তার সকল বন্দোবস্ত করলেন।

২০০৯ সালের পূর্বে দলের প্রধান বা দলের প্রথম সারির নেতাদের বিরুদ্ধে সাধারণত মামলা বা হয়রানি করার রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসেই বিএনপির চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা-হয়রানির তা-ব শুরু করলেন। যারদরুণ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দাঁড়ায় ৩৭টি এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে তার দ্বিগুণ সংখ্যক মামলা হয়। এখানেই শেষ নয়, দলটির মহাসচিবের বিরুদ্ধে মামলা শতাধিক, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিবের বিরুদ্ধে ১৮০, যুগ্ম-মহাসচিব হাবিব উন নবী সোহেলের বিরুদ্ধে ৪৫০, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ২৫০। এভাবে দলের স্থায়ী ও নির্বাহী কমিটি, জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ের প্রতিটি নেতাকর্মী সমর্থকদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৩০টি মামলা হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিএনপির বিরুদ্ধে ৬০ লাখ মামলা ও এক লাখ পঞ্চাশ হাজার আসামি করা হয়েছে। পৃথিবীর কোনো নিকৃষ্ট দেশেও কোনো স্বৈরাচারী সরকার তার বিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে এত মামলা করেছে কিনা তার নজির নেই। গত সাড়ে পনের বছরে কেবলমাত্র ক্রসফায়ারে বিএনপির প্রায় ২২০০ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। পিটিয়ে মেরেছে প্রায় ২৫০০ নেতাকর্মীকে। এক লাখের বেশি নেতাকর্মীর কারো চোখ-কান-হাত-পা হারিয়ে আজ পঙ্গু। এটা কী ভাবা যায়? ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে ৪৪০ জন প্রাণ দিয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মী আহত হয়েছে।

যে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করলো, লাখ লাখ নেতাকর্মীকে মিথ্যা গায়েবী মামলা দিয়ে হয়রানি করলো, প্রায় ৫৫০০ প্রাণ কেড়ে নিলো, ন্যূনতম রাজনীতি করার স্পেইস দিল না। এমনকি যারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মাত্র ১৭ দিনে ১৪০০ শিশু-জনতার জান কেড়ে নিলে, ৩০ হাজার মানুষকে আহত করলো, তাদের স্বাভাবিক রাজনীতি করার সুযোগ করে দেবে বিএনপি, এটা বিশ্বাস হয় না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঠিকই বলেছেন, আমরা জনগণের জন্য রাজনীতি করি, ক্ষমতা নেয়া বা ধরে রাখার জন্য নয়। জনগণই সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে আগামীতে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে, কী পারবে না।

লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

সূত্র, ইনকিলাব