ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে দিয়ে ভারত দীর্ঘ দেড় দশক ধরে বাংলাদেশকে তার করদরাজ্যে পরিণত করে রেখেছিল। তাকে দিয়ে তার সব চাহিদা পূরণ করে নিয়েছে। চহিবামাত্র ভারতকে সব উজাড় করে দিয়েছেন। বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি। শেখ হাসিনা নিজে বলেছিলেন, ভারতকে যা দিয়েছি, তা সে সরাজীবন মনে রাখবে। শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে ভারতের দাসী হয়ে তার সেবা করে গেছেন। ফলে দেশের মানুষ গণঅভ্যুত্থানে তার পতন এবং ভারতে পালিয়ে যাওয়াকে বাংলাদেশে ভারতের আধিপত্যবাদের পতন হয়েছে বলে মনে করে। ভারত সেটা মেনে নিতে পারেনি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সে অব্যাহতভাবে বৈরি আচরণ করে যাচ্ছে। বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে বাংলাদেশের সাথে শত্রুতামূলক মনোভাব পোষণ করে চলেছে। সীমান্ত হত্যা বৃদ্ধি, স্থলপথে পণ্য আমদানি-রফতানি বন্ধসহ ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশী বলে পুশ ইন করার মতো উসকানিমূলক কর্ম করে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্য-বিবৃতিকে প্রশ্রয় দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার তাকে নিবৃত্ত করতে ভারতকে অনুরোধ করেও সাড়া পায়নি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠানোর কথা বললে, সে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে এবং ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব প্রকাশ করে আসছে।Travel packages

গত বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য সাবেক কূটনৈতিক ও বিশেষজ্ঞদের বৈঠকের প্রাক্কালে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জয়সোয়াল বলেছেন, ‘সহায়ক পরিবেশে’ বাংলাদেশের সাথে সব বিষয়ে ভারত আলোচনা করতে আগ্রহী। পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করতে আমরা প্রস্তুত। তার এ বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝা যায়, ভারত বাংলাদেশের সাথে নতুন করে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায়। পর্যবেক্ষকরা একে ইতিবাচক হিসেবে মনে করছেন। কারণ, ভারত বাংলাদেশের দূরের প্রতিবেশী নয়, একেবারে লাগোয়া প্রতিবেশী। তার সাথে বিশ্বের দীর্ঘতম (প্রায় ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার) সীমান্ত রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, ৫৪টি অভিন্ন নদনদীর পানি বন্টনসহ নানা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। তবে ভারতের দাদাগিরি ও আধিপত্যবাদী নীতি এ সম্পর্ককে দীর্ঘদিন ধরেই বৈরি করে রেখেছে। ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে শ্রদ্ধার চোখে দেখে না। অথচ যেকোনো দেশের সাথে, সেটা প্রতিবেশী হোক, কিংবা দূরের দেশ হোক, সম্পর্ক হতে হয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মানের ভিত্তিতে। প্রতিবেশীর সাথে সম্পর্ক থাকে, সৎ প্রতিবেশী নীতি এবং সার্বভৌম সমতার নীতির মাধ্যমে। ইউরোপের দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা তা দেখতে পাই। অনেকগুলো দেশ একে অপরের সাথে স্থলসীমান্ত দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং তারা পারস্পরিক স্বার্থ, সম্মান ও শ্রদ্ধার সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ। কেউ কারো উপর আগ্রাসী মনোভাব পোষণ করে না। উপমহাদেশে ব্যতিক্রম শুধু ভারত। সে তার প্রতিবেশীদের সাথে আগ্রাসী ও আধিপত্যবাদী সম্পর্ক প্রদর্শন করে আসছে। ভারত এখন বাংলাদেশের সাথে সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক করতে আগ্রহী। আমরাও চাই, উভয় দেশের মধ্যে সম্মান ও সমমর্যাদার সম্পর্ক গড়ে উঠুক, যার মধ্যে কোনো ধরনের আধিপত্যবাদী মনোভাব থাকবে না। তবে ভারতের হঠাৎ সুসম্পর্ক গড়ার আগ্রহ প্রকাশ করার কারণ কি? এ নিয়ে পর্যবেক্ষকরা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে করা গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হতে যাচ্ছে। তার আগে ভারত বিদ্যমান চুক্তির শর্তাবলী পর্যালোচনা ও তার স্বার্থে নতুন কাঠামোগত চুক্তি নবায়নের পরিকল্পনা করেছে। বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী, মার্চ থেকে মে মাসের ১১ তারিখ পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে উভয় দেশ ১০ দিনের জন্য পালাক্রমে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। এখন পশ্চিমবঙ্গে সেচ, বন্দর রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ভারত চুক্তির সংশোধন চাচ্ছে। একই সময়ে সে আরও ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি চাচ্ছে। এ কারণেই ভারত তার স্বার্থে বিদ্যমান চুক্তি বাইপাস করে নতুন চুক্তি করার জন্য সুসম্পর্কের কথা বলছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, গঙ্গাচুক্তি অনুযায়ী, ভারত কখনোই বাংলাদেশকে ন্যায্য পানি দেয়নি। এজন্য, বাংলাদেশ বিকল্প গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েও ভারতের বাধায় তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। অন্যদিকে, তিস্তা চুক্তি করার কথা বলেও করেনি। উল্টো হাসিনা সরকার মানবিকতার কথা বলে ফেনী নদী থেকে ভারতকে পানি উত্তোলনের সুবিধা দিয়েছে। অভিন্ন নদনদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ভারত বাংলাদেশকে কখনোই দেয়নি। ভারতের এই বৈরি পানি নীতির কারণে বাংলাদেশের নদনদীগুলো নাব্য হারিয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণ চলছে। সীমান্ত হত্যা অব্যাহতভাবে চলছে। পুশ ইনের মাধ্যমে ভারতীয়দের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। গত সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গের একদল ভারতীয়কে পুশ ইন করার চেষ্টা করেছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী গত মাসে বলেছেন, তারা কোনো নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করেই পুশ ইন অব্যাহত রাখবেন। অথচ পুশ ইনের ব্যাপারে বাংলাদেশ বারবার বলেছে, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী যাচাই করে বাংলাদেশী হলে তাদের ফেরৎ নেবে। ভারত তা আমলে না নিয়ে পুশ ইন চালিয়ে যাচ্ছে। জয়সোয়াল যখন সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলে ব্রিফিং করছিলেন, প্রায় একই সময়ে তার সরকার বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে ৯ ধরনের পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ভারতের এই চরম বিদ্বেষমূলক আচরণ কি সম্পর্ক উন্নয়নের পথকে মসৃণ করে? প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক স্বার্থে ভারতের ল্যান্ডলকড সেভেন সিস্টার্স, ভুটান ও নেপালকে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের কথা বলেছেন। এতেও ভারত নাখোশ হয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছে। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের এই বৈরি মনোভাব এবং হীনমন্যতার পরিবর্তন হয়নি। সে উদার মনে পারস্পরিক স্বার্থে বৃহৎ কল্যাণের কথা ভাবতে পারে না। এমন আচরণ ও চিন্তা নিয়ে কী করে পারস্পরিক স্বার্থগত সম্পর্ক উন্নয়ন হবে?Travel packages

বাংলাদেশের সাথে পারস্পরিক স্বার্থ, সম্মান ও মর্যাদার সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হলে ভারতকে তার জেদ ও বৈরি মনোভাবের পরিবর্তন করতে হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র এবং এর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা পোষণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে যে পারস্পরিক মর্যাদা ও সমতাভিত্তিক স্বার্থের সম্পর্ক থাকে, সে অনুযায়ী তাকে আচরণ করতে হবে। ভেতরে প্রতিহিংসা বা বিরূপ মনোভাব পোষণ করে মুখে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বললে হবে না। কথা ও কাজে মিল থাকতে হবে। কারণ, ভারতকে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। এ বিশ্বাস ভারত তার নেতিবাচক আচরণের কারণেই হারিয়েছে। ফলে তাকেই তার সৎ ও বন্ধুত্বসুলভ প্রতিবেশীর আচরণ ও আন্তরিকতা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। ভারত যদি মনে করে থাকে, শেখ হাসিনাকে দিয়ে যেভাবে একতরফাভাবে তার স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে, সেভাবে অন্তর্বর্তী সরকার বা তার পরবর্তী সরকারের মাধ্যমে আদায় করে নিতে পারবে, তার সে আশা পূরণ হবে না। ভারতের সাথে শেখ হাসিনা অনেক গোপন চুক্তি করেছে। এসব চুক্তি প্রকাশের দাবিও উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার তা এখনো প্রকাশ করেনি। এসব গোপন চুক্তি সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সন্দেহ হয়ে থাকবে। সরকারের উচিৎ, সেসব চুক্তি অবিলম্বে প্রকাশ করা। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নে ভারত কথা বলতে চায়, এটা ভালো কথা। তবে পারস্পরিক সমতাভিত্তিক স্বার্থ বজায় রেখে তা করতে হবে।

সূত্র, ইনকিলাব