১৯৬৮-৭৩ সময়কালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তখন শহীদ আব্দুল মালেক ছিলেন ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি। আমি ছিলাম কর্মী। আব্দুল মালেক ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ছিলেন তুখোড় বক্তা। বিরোধী শিবির সবসময় তার যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যে ধরাশায়ী হতো।
আল্লাহর ঘোষণা, ‘এ সময়কালে (ইতিহাসের গতিধারায়) আমি মানুষের মধ্যে আবর্তিত করে থাকি। এর পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে করে আল্লাহ বাস্তবে দেখে নেন তোমাদের মধ্যে কারা ঈমানের দাবি পূরণ করল, আর তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোককে তিনি শহীদ হিসেবে গ্রহণ করেন, আর আল্লাহ অন্যায় আচরণকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আল ইমরান-১৪০)
আব্দুল মালেক আল্লাহর সেই সৌভাগ্যবান বান্দাদের একজন, যারা ঈমানের দাবি পূরণ করেছেন এবং যাদের আল্লাহ শহীদ হিসেবে কবুল করে নিয়েছেন। শহীদ মালেকের জীবনের শেষ ক’টি দিনের স্মৃতিচারণে আজকের এ প্রয়াস।
১৯৬৮-৭৩ সময়কালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তখন শহীদ আব্দুল মালেক ছিলেন ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি। আমি ছিলাম কর্মী। আব্দুল মালেক ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ছিলেন তুখোড় বক্তা। বিরোধী শিবির সবসময় তার যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যে ধরাশায়ী হতো।
১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পদত্যাগের পর দেশব্যাপী দাবি উঠেছিল শিক্ষা সংস্কারের। ইয়াহিয়া সরকার এয়ার মার্শাল নূর খানকে প্রধান করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। নূর খান দায়িত্ব নেয়ার ছয় মাসের মধ্যেই একটি সুপারিশমালা পেশ করেন। এতে প্রাথমিক স্তর থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত আরবি ও ইসলামী শিক্ষা বিষয় বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়। দেশের আপামর জনসাধারণ একে স্বাগত জানায়। বামপন্থী ছাত্র সংগঠন এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। বামপন্থীদের নেতৃত্বে ছিল ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমদ, অ স ম আব্দুর রব এবং ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মাহবুবুল্লাহ প্রমুখ।
সিদ্ধান্ত হলো ১৯৬৯ সালের ১২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) এ বিষয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে। নূর খান শিক্ষা কমিশনের পক্ষে প্রধান বক্তা ছিলেন আব্দুল মালেক। আর বিপক্ষের বক্তা তোফায়েল আহমদ, আ স ম আব্দুর রব প্রমুখ।
আমার প্রতি নির্দেশ ছিল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার, কিন্তু পারিবারিক কারণে আমাকে জরুরি ভিত্তিতে বাড়ি যেতে হয়। আব্দুল মালেকের যুক্তিপূর্ণ ও তথ্যভিত্তিক বক্তব্য খণ্ডন করার সামর্থ্য তোফায়েল ও তার সাথীদের ছিল না। তারা গোপনে ছাত্র-শিক্ষক সম্মেলন কেন্দ্রে কিছু হকিস্টিক এবং ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে যায়। আব্দুল মালেক যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, তখন তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রব গং একযোগে হইচই করে তার ওপর হামলা করে। একপর্যায়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে তার মাথা থেঁতলে দেয়া হয়।
আব্দুল মালেককে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে হামলাকারীরা চলে যায়। সঙ্ঘের কর্মীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। পরের দিন জাতীয় দৈনিকগুলোতে তোফায়েল আহমেদ ও আব্দুর রবের হাতে হকিস্টিক ও ক্রিকেট ব্যাটের ছবিসহ আব্দুল মালেককে আঘাত করার ছবি প্রকাশিত হয়।
মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে সংজ্ঞা হারান। পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ শৈল্য চিকিৎসক জুম্মা খানকে নিয়ে আসা হয়। জরুরি অস্ত্রোপচার করেন তিনি। বাঁচানো গেল না আব্দুল মালেককে, ১৫ আগস্ট, ১৯৬৯ তিনি শহীদ হন।
দুঃখের বিষয়, পাকিস্তান নামক যে দেশটি ইসলামের নামে অর্জিত হয়ছিল, সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘ দুই দশকের অধিককাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ইসলামী জ্ঞানদানের ব্যবস্থা করা যায়নি। যার কারণে পাকিস্তান অর্জনের ২৪ বছরের মাথায় তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং হিন্দুত্ববাদী ভারত যেভাবে জেঁকে বসেছে, তা থেকে জাতি এখনো মুক্ত হতে পারেনি। বরং শেখ হাসিনার ১৬ বছরের স্বৈরশাসন আমলে প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে গোটা জাতিকে নৈতিকভাবে দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এখন স্বৈরশাসনমুক্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজানো।
লেখক : আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের সাবেক ভিসি
সূত্র,নয়া দিগন্ত