যে কোনো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপর আগ্রাসন চালানো কেবল অযৌক্তিক ও অমানবিকই নহে, বরং আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। অতীতে প্রায়শই দেখা গিয়াছে যে, যুদ্ধের পূর্বে পরাশক্তিগুলি এক দেশকে পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হইতে দেওয়া হইবে না বলিয়া হুংকার ছাড়িলেও, যুদ্ধের মূল লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত 'রিজিম চেঞ্জ' বা শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়। এই দ্বৈতনীতি অত্যন্ত বিস্ময়কর। একদিকে, যেই সকল দেশের হাতে শত শত পারমাণবিক বোমা মজুত রহিয়াছে, তাহারা অন্যদেরকে এই মারণাস্ত্রের অধিকারী হইতে দিতে চাহে না, অন্যদিকে নিজেরাই পরমাণু অস্ত্রের উৎপাদন ও মজুত বৃদ্ধি করিয়া চলিয়াছে। এ কেমন বিচার? পরমাণু অস্ত্র কেবল মুষ্টিমেয় কিছু দেশের হাতে থাকিবে আর অন্যদের জন্য ইহা নিষিদ্ধ হইবে-এই যুক্তি তথ্যপ্রযুক্তির এই আধুনিক বিশ্বে কতটা গ্রহণযোগ্য? স্বাধীনতা অর্জনের পর ইউক্রেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়া) নিকট হইতে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র। সেই সময় তাহার নিকট ছিল বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার। প্রায় ১ হাজার ৭০০ হইতে ১ হাজার ৯০০টি কৌশলগত পারমাণবিক ওয়ারহেড ছিল; কিন্তু ১৯৯৪ সালে বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডাম স্বাক্ষর করিবার পর নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ১৯৯৬ সালের মধ্যে সমস্ত পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়ার নিকট হস্তান্তর করা হয়। পরাশক্তিদের এমন চাপে নিরস্ত্রীকরণে বাধ্য না হইলে আজ ইউক্রেনের হতভাগ্য নাগরিকদের এমন করুণ পরিণতি বরণ করিতে হইত না!

gnewsদৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন

বর্তমানে বিশ্বে মোট প্রায় ১২ হাজার ১০০-এর অধিক পরমাণু বোমা বিদ্যমান, যাহার সিংহভাগই পৃথিবীর দুইটি প্রধান শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দখলে। ইহা ছাড়াও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইসরাইল এবং উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। অন্যদিকে, ইরান ও অন্য কতিপয় দেশ পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করিতেছে বলিয়া অভিযোগ রহিয়াছে। এই পরিস্থিতিতে, 'রিজিম চেঞ্জ' যদি যুদ্ধের মূল লক্ষ্য হয়, তাহা হইলে তাহা অত্যন্ত বিপজ্জনক। ইরানের শাহের পতনের কথাই ধরা যাউক। আধুনিক ইরান গঠনে তাহার ভূমিকা অনস্বীকার্য হইলেও, তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দিতে গিয়াই তিনি তাহার মিত্রদের বিরাগভাজন হন এবং পরবর্তী সময়ে তাহার পতন ঘটে। ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট মারকোসও একসময় তাহাদের প্রিয়পাত্র ছিলেন; কিন্তু তাহার পতনের পূর্বে দুর্নীতি ও তাহার স্ত্রীর জুতা কেলেঙ্কারির সংবাদ বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমে ফলাও করিয়া প্রচার করা হয়। এই সকল ঘটনা হইতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বের প্রভাব বিস্তারকারী গণমাধ্যমের বয়ান অনেক সময়ই কোনো শাসকের আসন্ন পতনকে নির্দেশ করে। ইহাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অর্থ কী দাঁড়ায়? যদি এই সকল সংবাদমাধ্যম বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তথ্য পরিবেশন করে, তবে সেই সকল দেশের জনগণও কি সঠিক তথ্য পাইতেছে? এমবেডেড জার্নালিজমের কথা তো বহুল আলোচিত ও সমালোচিত।

একটি স্বাধীন দেশের শাসনব্যবস্থা কেমন হইবে, তাহা নির্ধারণের অধিকার কেবল সেই দেশের জনগণেরই রহিয়াছে, অন্য কোনো রাষ্ট্রের নহে। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করিবার পূর্বেও তাহার কাছে নিউক্লিয়ার বোমা আছে বলিয়া বিশ্ব জুড়িয়া সংবাদমাধ্যমে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হইয়াছিল, যাহা পরে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিতও হয়। আসলে পৃথিবীতে কী ঘটিতেছে? আমরা কি এমন এক পৃথিবীতে বসবাস করিতেছি, যেইখানে শক্তিই শেষ কথা? 'মাইট ইজ রাইট' বা 'জোর যার মুল্লুক তার' নীতিরই কি বিজয় কেতন উড়িতে থাকিবে? পৃথিবী কি 'মগের মুল্লুক' হইয়া যায় নাই? গাজায় ইচ্ছামতো নিধনযজ্ঞ ও গণহত্যা চালানো হইতেছে। কোথায় বিশ্বের বিবেক, কোথায় সভ্যতা ও মানবতা? পৃথিবীতে এই গুন্ডা ও মাস্তানতন্ত্রের জয়জয়কার কে থামাইবে?

যুদ্ধাক্রান্ত ও আগ্রাসনের সর্বশেষ শিকার দেশটির প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বারংবার বলিতেছেন যে তাহারা পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হইতে চাহেন না। তাহাদের এমন উদ্দেশ্যও নাই। তবে শান্তিপূর্ণ কাজে তথা জ্বালানি উৎপাদন ও বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের অধিকার সকলেরই রহিয়াছে। এখন প্রশ্ন হইল-এই অধিকারও কাড়িয়া লওয়া হইবে? বিশ্বে যেই পর্যন্ত দ্বিমুখীনীতির অবসান না হইবে, সমতা ও নায্যতার ভিত্তিতে পৃথিবী না চলিবে, ততদিন এই বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সত্যিই কঠিন ও দুরূহ কাজ।

সূত্র, ইত্তেফাক