গত সপ্তাহজুড়ে দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দাবিদাওয়া সংক্রান্ত যে আন্দোলন এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের চিন্তাভাবনা সংক্রান্ত অস্থিরতামূলক ঘটনা ঘটেছে, তার সবই মূলত রাজনৈতিক সংকট থেকে উদ্ভুত। এর অন্তর্গত বিষয় হচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখসহ রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য সরকারের ওপর একধরনের চাপ বা তাকিদ দেয়া। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও নির্বাচন, মিয়ানমারে মানবিক করিডোর ও চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের কাছে লিজ দেয়া নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এতে সরকারের ভেতরে থাকা কিছু উপদেষ্টা ও তাদের সমর্থনকারি দুয়েকজন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট অনেকটা তেলেবেগুণে জ্বলে ওঠেন। তারা বরাবরই নির্বাচন বিলম্বিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, তারা নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে নানাভাবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রভাবিত করে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন, ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিৎ। সেনাবাহিনীর অফিসার্স অ্যাড্রেস ভাষণে তিনি ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার কথা বলেছেন। তার এ অবস্থানকে কেন্দ্র করে দুয়েকজন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও তাদেরকে পেছন থেকে উসকে দেয়া সরকারের কুচক্রি মহল তাকে ও সেনাবাহিনীকে নানাভাবে বিতর্কিত এবং অপপ্রচার চালিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছেন। কিছুদিন আগে কোনো কোনো ছাত্র সমন্বয়ক টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে ওয়াকার-উজ-জামানকেও বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন। একজন ছাত্র উপদেষ্টাও সম্প্রতি সেনাবাহিনীকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিতর্ককে উসকে দিয়েছেন, যা কোনোভাবেই সঠিক হয়নি। কুচক্রি মহলটি জালিয়াতিরও আশ্রয় নিচ্ছে। তারা সেনাবাহিনীর লগো ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ও গুজব ছড়িয়েছে। এ নিয়ে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে দেশবাসীকে সচেতন ও সতর্ক থাকারও আহ্বান জানানো হয়েছে।

দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীই শেষ ভরসা। এ বাহিনী দুর্বল বা অকার্যকর হলে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বলে কিছু থাকে না। প্রত্যেক দেশই তার সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর গৌরবজ্জ্বোল ভূমিকা প্রশ্নাতীত। এর মধ্য দিয়েই এটি গড়ে উঠেছে। স্বাধীনতার পর দেশের যেকোনো ক্রাইসিস মোমেন্ট এবং জাতীয় দুর্যোগে সেনাবাহিনী সবসময়ই দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রায় প্রত্যেক দেশের সশ্রস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠে একটি ‘হোস্টাইল এনিমি’ বা কমন শত্রুকে সামনে রেখে। আমাদের সেনাবাহিনীও গড়ে উঠেছে ভারতের মতো ‘হোস্টাইল এনিমি’ সামনে রেখে। এর শীতকালীন প্রশিক্ষণ এবং মহড়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাই হয়ে থাকে। এটা সকলেরই জানা, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য একমাত্র হুমকি ভারত। স্বাধীনতার পর থেকে সে নানাভাবে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হানার চেষ্টা করেছে। এখনো করে যাচ্ছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে দিয়ে দেড় দশক ধরে দেশকে তার করদরাজ্যে পরিণত করে রেখেছিল। ভারতের বিজেপি সরকারের নেতা ও বিভিন্ন ব্যক্তি আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে অনবরত কটাক্ষ করে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে কেউ কেউ বলেছেন, একাত্তরেই বাংলাদেশ দখল করে নেয়া উচিৎ ছিল, কিংবা বাংলাদেশের একাংশ দখল করে নেয়া দরকার। এর কোনো প্রতিবাদ সে সময় হাসিনা সরকার করেনি। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এদেশে ভারতেরও পতন হয়েছে বলে দেশের মানুষ মনে করে। তবে মোদি এ পতন মেনে নিতে না পেরে অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকে শেখ হাসিনাকে সাথে নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র, উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্র-জনতা তাদের সে ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছে এবং ভারতের চোখে চোখে রেখে কথা বলছে। সীমান্তে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিএসএফের অন্যায় আচরণ রুখে দিচ্ছে। তারপরও ভারত নানাভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। ‘পুশ ইন’-এর নামে ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে একটি কুচক্রি মহল সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার জন্য নানা অপপ্রচার ও গুজব রটিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীকে নিয়ে এ ধরনের অপপ্রচার ও গুজব রটানো অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তারা যে সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খল করতে চাচ্ছে, তা বুঝতে বাকি থাকে না। তাদের মনে রাখা প্রয়োজন, গণঅভ্যুত্থানে সেনাবাহিনী শেখ হাসিনার হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়ে জনগণের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। তারা জনগণের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। সেনা-জনগণের ঐক্য সৃষ্টি করে বিজয়কে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। সেনাবাহিনীর এ ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসার এবং মূল্যায়নের দাবি রাখে। শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সেনাপ্রধান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের মানুষ তা দেখেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বলতে কিছু ছিল না, জননিরাপত্তা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তখন সেনাবাহিনী মাঠে নেমে তা সামাল দিয়েছে এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী সে সময় মাঠে না থাকলে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, একটি স্বার্থান্বেষী ও কুচক্রি মহল এখন অন্তর্বর্তী সরকার ও সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি করতে চাচ্ছে। দেশকে অস্থিতিশীল ও আগামী জাতীয় নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। আশার কথা, সরকার ও সেনাবাহিনী কুচক্রি মহলের এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরেছে। এই ঐক্য বিনষ্টকারিদের বিরুদ্ধে সরকার ও দেশবাসীকে সচেতন থাকতে হবে। তাদের অহেতুক গুজব ও অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাওয়া জাতির জন্য গৌরবের বিষয়। তিনি মহীরুহ। তাঁর বিচক্ষণতা প্রশ্নাতীত। পর্যবেক্ষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারে কিছু অপরিপক্ক, অদক্ষ ও ক্ষমতা উপভোগকারি উপদেষ্টা তাঁকে ঘিরে রেখে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের ভেতরে থেকে তারা জনআকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে কাজ করছে। এটা দেশবাসীর কাছে পরিস্কার। এসব উপদেষ্টাকে দ্রুত সরিয়ে দেয়া এখন সময়ে দাবি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে সচেতন মহল একমত, দেশে যেসব অস্থিরতামূলক ঘটনা ঘটছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে এবং দেশকে স্থিতিশীল করতে একমাত্র উপায় দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিৎ, বিষয়টি অনুধাবন করে অবিলম্বে এ পদক্ষেপ নেয়া। যত দেরি হবে, পতিত শেখ হাসিনা ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা ষড়যন্ত্র করে দেশকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। তারা যাতে কোনোক্রমেই এ সুযোগ বা স্পেস না পায়, জাতীয়ভাবে তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা করে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। স্মরণে রাখতে হবে, সশস্ত্র বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও সরকার ঐক্যবদ্ধ থাকলে ষড়যন্ত্রকারীরা যতই চক্রান্ত করুক, কখনোই সফল হতে পারবে না।

সূত্র, ইনকিলাব