’২৪-এর জুলাই-পরবর্তী রাজনীতিতে ন্যারেটিভ বা বয়ান একটি বহুল পরিচিত শব্দ। যেখানে তরুণ প্রজন্ম ও সচেতন মহলের কণ্ঠে বারবার ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশ গড়তে রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে নতুন ভাষা ও বয়ানের কথা বলা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জুয়ান লিঞ্জের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিশ্লেষণ উল্লেখ করা যায় : যে কোনো শাসকগোষ্ঠী তখনই চূড়ান্ত ক্ষমতাবান হয়ে উঠে, যখন তা নিজের বয়ানকে একমাত্র সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে এবং বিরোধী মতকে রাষ্ট্রবিরোধী বা শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে।

অন্যদিকে হান্না আরেন্ডটের (পলিটিকাল লাইজ) বা রাজনৈতিক মিথ্যার ধারণা অনুযায়ী, এ প্রক্রিয়া কেবল রাজনৈতিক প্রচারণা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক কৌশল, যা জনগণের বিচারশক্তিকে বিকৃত করে এবং ‘মিথ্যাকে’ সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ‘সত্যে’ রূপান্তরিত করে। ইতালিয়ান দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামসির কালচারাল হেজিমনি বা সাংস্কৃতিক আধিপত্য তত্ত্ব এ প্রক্রিয়াকে আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করে। তার মতে, ক্ষমতা কেবল বলপ্রয়োগ বা আইনের মাধ্যমে নয়, বরং সাংস্কৃতিক হেজেমনির মাধ্যমে টিকে থাকে। বাংলাদেশে এ বাস্তবতাকে বুঝতে পতিত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী ১৪ দল মিলে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তাদের ফ্যাসিবাদী ক্ষমতাকে বৈধতা দিতে এবং বিরোধী রাজনীতিকে দমন করতে যে ধারাবাহিক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক বয়ান তৈরি ও প্রয়োগ করেছে, তা বিশ্লেষণ করা উচিত। এ সময়কালে আওয়ামী লীগ ও ভারতপন্থি বাম অংশ ১৪ দলের সঙ্গে মিলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে নানা বিভক্তিমূলক বয়ানকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছায় এবং তাদের বিশেষ ফ্যাসিবাদী প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, যা কেবল স্বৈরাচারীভাবে ক্ষমতা দখল নয়, বরং অবৈধ ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য একটি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলে।

প্রথমত, যাকে-তাকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ ও ‘রাজাকার’ তকমা দেওয়া ছিল ফ্যাসিবাদের অন্যতম বয়ান। এছাড়া ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের প্রহসনমূলক নির্বাচনের বৈধতা তৈরির জন্য বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতকে সরাসরি ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ হিসাবে চিহ্নিত করে। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনে ‘ফাঁসি চাই’, ‘জবাই চাই’ স্লোগান ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ ও ভারতপন্থি বামরা বিরোধীদের গণহত্যাকারী, রাজাকার বা পাকিস্তানি এজেন্ট হিসাবে তুলে ধরে ও পরবর্তীকালে প্রশ্নবিদ্ধ বিচারের মাধ্যমে অনেককে ফাঁসি ও কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে শুধু ধর্মভিত্তিক দল জামায়াত নয়, বিএনপিকেও একই কাতারে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা একরকম বৈধ রূপ পায়।

দ্বিতীয়ত, বিরোধী ও মুসলিম উপায়-উপকরণকে ‘জঙ্গিবাদ’ ফ্রেমিংয়ের বয়ান। বিএনপি-জামায়াতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য প্রায় প্রতিটি আন্দোলনকে ‘জঙ্গিবাদী’ বা ‘উগ্র ইসলামপন্থিদের’ আন্দোলন আখ্যা দেওয়া হয়; যা আন্তর্জাতিক বিশ্ব তথা পশ্চিমা ‘ওয়ার অন টেরর’ পলিসির সঙ্গে মিলে গিয়ে সরকারের এক ধরনের মিথ্যা বৈধতা তৈরি করে।

তৃতীয়ত, ‘হাসিনা ছাড়া বিকল্প নেই’। এটি ছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী ও ভারতপন্থি বামদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রোপাগান্ডা। টকশো, সম্পাদকীয়, কলাম, গবেষণা রিপোর্ট, পরিসংখ্যান, নাটক, গান, সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট ও উদীচী, ছায়ানটসহ শিল্পকলার নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনে এ বয়ানকে এমনভাবে ছড়ানো হয়, যাতে মনে হয় বাংলাদেশের অস্তিত্ব, নিরাপত্তা ও অগ্রগতি কেবল শেখ হাসিনার সঙ্গেই জড়িত। বিদেশি কূটনীতিক ও উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গেও বিভিন্ন এনজিও ও সিভিল সোসাইটি সংগঠনের মাধ্যমে এ বার্তা বিনিময় করা হয়, যেন কোনো বিকল্প শক্তি ক্ষমতায় এলে ‘বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ পরিণত হবে, একইসঙ্গে তা ভারতের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে উঠবে। যে কারণে ভারতের অন্ধ সমর্থন ও কূটনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পেরেছে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রেজিম।

চতুর্থত, ‘উন্নয়ন মানে হাসিনা’ ও ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’। এ বয়ান তৈরি করা হয়, যাতে মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার হারানোকে তেমন গুরুত্ব না দেয়। মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, ফ্লাইওভার, ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রভৃতি মেগা প্রজেক্টের নামে দুর্নীতির মহাউৎসবকে ‘হাসিনা উন্নয়ন মডেল’ হিসাবে প্রচার করা হয়।

পঞ্চমত, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলন একমাত্র আওয়ামী লীগের সম্পত্তি হিসাবে ফ্যাসিবাদী মিডিয়া ও সুশীল সমাজের নেক্সাসের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। ‘আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র পক্ষ’ এ বয়ানটির মাধ্যমে ইতিহাসকে একমুখী করা হয়। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি, ছাত্র-যুব সংগঠন বা সাধারণ বাংলাদেশি মুসলমান-হিন্দু-নৃগোষ্ঠীর ভূমিকা আড়াল করা হয়। একইসঙ্গে পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রে বারবার আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক ও জেড ফোর্সের কমান্ডার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বীর উত্তমকে পাকিস্তানের চর হিসাবে আখ্যায়িত করে সরকার। এছাড়া শুধু আওয়ামী লীগ বা বাম দলগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকলে আরও বলা হয় ‘একবার রাজাকার মানে চিরকাল রাজাকার, কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা মানে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়’, যার শিকার হয়েছিলেন বাংলার আধুনিককালের অন্যতম শক্তিমান কবি আল মাহমুদও।

ষষ্ঠত, ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা’, ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’সহ মুজিববর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বঙ্গবন্ধু এবং শেখ পরিবারের ব্যক্তিকেন্দ্রিক পূজা চালু করা হয়। শত শত কোটি কোটি টাকা সরকারি অনুদানে সেমিনার, প্রবন্ধ, সিনেমা, নাটক, বই, কনসার্ট ও গান প্রদর্শনী হয়, যেখানে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনাকে অতিমানবীয় রূপে উপস্থাপন করা হয়। এর বিরুদ্ধে অনলাইন ও অফলাইনে যে কোনো ধরনের সমালোচনা করাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বা দেশবিরোধী তকমা দিয়ে মামলা-হামলা, জেল ও গুমের মাধ্যমে দমন করা হয়।

সপ্তমত, সরকারের প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ নির্দেশনায় কিংবা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বড় বড় সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সম্পাদকীয় নীতি এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে সরকারের বিপক্ষে কোনো খবর বা মতামত প্রকাশিত হতে না পারে। আওয়ামী লীগের রিসার্চ উইং সিআরআইয়ের সহযোগিতায় বিপুলসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, লেখক, গায়ক, খেলোয়াড় ও ইনফ্লুয়েন্সারদের সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যুক্ত করা হয় ফ্যাসিবাদী নানা বয়ান প্রচারে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ, টকশো, বিশ্ববিদ্যালয় সেমিনার, এনজিও রিপোর্ট সবকিছুই এক কণ্ঠে সরকারের অবস্থানকে বৈধতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ হয়ে উঠতে উসকানি দিতে থাকে।

অষ্টমত, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রোপাগান্ডা, বিদেশি সংবাদমাধ্যমে বিশেষ করে দ্য ইকোনমিস্ট, ওয়াশিংটন পোস্ট, আল-জাজিরা ইত্যাদির সরকারের স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিবেদনকে ‘ভাড়াটে সাংবাদিকদের’ প্রতিবেদন অথবা কখনো ‘বিএনপি-জামায়াতের দালাল’ বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়। অন্যদিকে কিছু লবিস্ট ফার্মের মাধ্যমে উন্নয়ন, নারী ক্ষমতায়ন ও জলবায়ু অভিযোজনের গল্প ছড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে হাসিনার সরকারকে ‘সফল মডেল’ হিসাবে প্রচার করা হয়।

সবশেষে, বারবার করে ফ্যাসিবাদী সব উপায়-উপকরণ ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের প্রায় ৯ শতাংশ ‘হিন্দু জনগোষ্ঠীর একমাত্র রক্ষাকারী’ হিসাবে দেখানো হয়েছে আওয়ামী লীগকে। বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিকভাবে বিএনপি-জামায়াত বা লীগের বাইরে অন্য কেউ ক্ষমতায় এলে হিন্দুদের ওপরে গণহত্যা চালানো হবে। যে অপপ্রচারের ধারাবাহিকতা আমরা দেখেছি হাসিনা পতনের পরও। অথচ পত্র-পত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যায়, ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু নিপীড়ন হয়েছে ফ্যাসিবাদের গত ১৫ বছরে এবং তার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জড়িত ছিল কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী নেতাকর্মীরা।

সুতরাং, যারা বাংলাদেশ ২.০-এর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বয়ান নতুন করে সাজাতে যাচ্ছে, তাদের উচিত এসব ফ্যাসিবাদী বয়ান ও প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে দেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতাকে ধারণ করে গণতান্ত্রিক দর্শন ও জনগণের অধিকারের চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়া। অন্যথায় বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার মুখে ঠেলে দেবে বাংলাদেশকে।

ড. মো. খালেদ হোসেন : একাডেমিক ডিরেক্টর, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশনাল স্টাডিজ

মুহাম্মাদ তালহা : রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশনাল স্টাডিজ

সূত্র, যুগান্তর